‘স্কুলকে মনে হতো যেন এক বন্দীশালা’
আমার জীবনের প্রথম স্কুল ছিল উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল। আমার বাবার চাচা, ব্যারিস্টার লুফে আলী চৌধুরীর সুপারিশে আমি এই স্কুলে ভর্তি হই ১৯৫৭ সালে। আমি তাঁকে ব্যারিস্টার দাদা বলে ডাকতাম। খুব ভয় পেতাম ব্যারিস্টার দাদাকে। কেন যে এত ভয় কাজ করতো জানি না, তবে তাঁকে দেখলেই টেবিলের নিচে গিয়ে লুকিয়ে পড়তাম। আমার মনে আছে, তার চলাফেরা ছিল কিছুটা বিলেতি কায়াদায়। সবসময় তার সাথে একটা লাঠি থাকত। উনি এলেই ওনার লাঠি আর শোলার টুপিটা নিয়ে পালাতাম আমি।
খুব ভালো ছাত্র ছিলেন আমার ব্যারিস্টার দাদা। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল' পাশ করে ভোলায় এসে আইনচর্চা শুরু করেন। বিয়ে করেছিলেন একজন ইংরেজ মহিলাকে। কিন্তু সে সম্পর্ক টেকেনি। তিন সন্তান হবার পর, এক ইংরেজের হাত ধরে তার স্ত্রী চলে যান। এরপর দাদা আর বিয়েও করেননি। একাই কাটিয়ে দিয়েছেন সারাটা জীবন।
ভয়টা যেমন কোনো কারণ ছাড়া ছিল, ভয়টা কেটেও গেল তেমন কারণহীনভাবেই। একদিন সামনে দেখা হবার পর হঠাৎ ভয়টা কেটে গেল। হয়তো মুখোমুখি হতাম না বলেই ভয়টা আর কাটতে চাইতো না।
স্কুলকে মনে হতো এক বন্দীশালা
স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জোসেফিন উইলস ছিলেন একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। আমরা তাঁকে মিসেস উইলস বলে ডাকতাম। আর প্রিন্সিপাল ছিলেন মিস্টার বারাক্লো। পুরো নাম মনে নেই। তবে তিনি কীভাবে হাঁটতেন, দেখতে কেমন ছিলেন- সেসব মনে আছে। চুরুট খেতেন এটা মনে আছে স্পষ্ট। কথা বলতেনও খুব জোরে জোরে। বাকি যেসব শিক্ষক ছিলেন, বেশিরভাগই ছিলেন বয়স্ক ইংরেজ বা অ্যাংলো।
আমার ভালো লাগতো না স্কুলে যেতে। শুনেছি ছোটবাচ্চাদের মনে স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে বলে স্কুলের প্রতি এক অন্যরকম আকর্ষণ জন্মায়। আমার হলো উল্টোটা। স্কুলকে মনে হতো এক বন্দীশালা। তাই স্কুল টানতো না আমাকে।
স্কুলটি এখনো আছে তবে এখন স্কুলটির স্থাপনায় কী কী পরিবর্তন এসেছে কে জানে। আদি বাড়িটার কী অবস্থা এখন? এখনো কি আছে? জানা নেই। তবে, স্কুলের ওপর তলায় থাকতেন উইলস পরিবার, এটুক মনে আছে। কয়েকবার যাওয়া হয়েছে সেখানে। পুরানো দিনের ইংরেজ বাড়িগুলো যেমন হয়ে থাকে, তেমনই ছিল সে বাড়িটা। দেয়ালে কয়েকটা বাঘের মাথা ছিল। একটা পুরোনো দিনের সিঁড়ি ছিল।
স্কুলে ঘোড়ার একটা আস্তাবল ছিল
সেখানে ঘোড়া গাড়ির ছাত্রী সার্ভিস চালু ছিল। তবে শুনতাম এইসব ঘোড়া রোববার দিন ঢাকার রেসের ময়দানে দৌড়াতো ও নিয়মিত ভাবে রেসে হারতো। এই সব ছিল উইলস সাহেবের কাজকর্ম।
মিসেস উইল তখন বোধহয় পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা-প্রধান ছিলেন। নারী শিক্ষা ও খেলাধুলায় বিশেষ অবদানের জন্য তাকে পাকিস্তান সরকার স্বীকৃতি দেয়।
যে সব শিক্ষক ছিলেন তারা এখন কই ? মানে অ্যাংলো গোষ্ঠী ?
১৯৭১ পর্যন্ত তারা দেশেই ছিলেন। এরপর চলে যান অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায়। শেষের দিকে যারা ছিলেন, তারাও ৮০'র দশকের পর চলে যান। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় বা ট্রাভেল এজেন্সিতে সেক্রেটারির কাজ করতেন এই গোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষেরা। আমার জানামতে, বর্তমানে এই গোষ্ঠীর কেউ নেই বাংলাদেশে।
টিফিনের আনন্দটাই সবচেয়ে বেশ মনে পড়ে
টিফিনের সময় খুব আনন্দ হতো। ঝাল মুড়ি , আইসক্রিম ও অন্য সব খাবার। আমার মা টিফিন বাক্সে সবসময় শুকনো খাবার ভরে দিতেন। যেমন রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি। পানি খাওয়ার জন্য আমাদের সবার সাথে বাহারি বোতল থাকতো। 'ওয়াটার বোতল' তখন ছিল এক বিশাল ব্যাপার। স্কুলে টিউবওয়েল থাকলেও, সে-ই পানি খাওয়ার অনুমতি আমার ছিল না। তখন থেকেই নিষিদ্ধ খাবারের প্রতি আমার একধরনের লোভ জন্মাতে শুরু করে। বিশেষ করে সেই ছোটোবেলার বেবি আইস্ক্রিমের প্রতি কি প্রবল লোভ ছিল। খাওয়ার অনুমতি থাকতো না সবসময়।
টয়লেটগুলো ছিল মারাত্নক নোংরা এবং সেই থেকে আমার চেপে রাখার অভ্যাসের শুরু। মেয়েদের খুব কষ্ট হতো দেখতাম।
ধর্ম বই ছিল না, এথিক্সের বই পড়তাম
রেডিয়েন্ট প্রথম ধাপ , দ্বিতীয় ধাপ এগুলো ছিল পড়ার বই। ধর্ম পড়ানোর বদলে 'এথিক্স' বা নৈতিকতা পড়ানো হতো। একটু উঁচু শ্রেনীতে উঠলে 'এথিক্স(নৈতিকতা)' নামক একটা বিষয়ই ছিল। পরে যখন পি এফ শাহীন (বর্তমান বি এফ শাহীন) স্কুলে যাই তখন প্রথম পরিচিত হই "ইসলাম শিক্ষা'র সঙ্গে।
তবে স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষক ছিলেন আমার প্রিয়। একজন ছিলেন, তাকে 'মিস ম্যারি' বলে ডাকতাম আমরা। মিস ম্যারিকে দেখে মনে হয়েছিল, উনি বিশ্ব সুন্দরী। উনার মতো এতসুন্দর কেউ হয় না। তার মা-ও এখানে পড়াতেন। মিস ম্যারি চুরুট খেতে পছন্দ করতেন।
একদিন পত্রিকা পড়ে জানলাম, মিস ম্যারি মারা গেছেন। তার কয়েক বছর পর একজনের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি আমাকে বললেন, আমাকে একটা পরিচিত জায়গায় নিয়ে যাবেন। আমিও গেলাম তার সাথে সাথে। গেলাম আমার স্কুলের ওপর তলায়।
বিছানায় পক্ষঘাতগ্রস্থ হয়ে শুয়ে আছেন মিস্টার উইলস। আমাকে দেখে তিনি চিনতে পারেননি। বললেন, 'আমার তো কিছু মনে নেই, কিছু মনে থাকে না এখন আর। তুমি আমার প্রাক্তন ছাত্র তাই না?'
সেই সাজানো ঘরের ছিটাফোঁটাও এখন আর নেই। ঘরের বিভিন্ন কামরায় এখন বিভিন্ন পরিবার থাকে। তার জন্য কেবল বসার ঘরটাই বরাদ্দ। দেয়ালে তাদের বিয়ের একটা বিশাল ছবি টাঙ্গানো। ছবিতে মিসেস উইলস হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
যখন ক্লাস থ্রি/ফোরে পড়ি , হাতে লাঠি দিয়ে মেরেছিলেন আমাকে। ব্যথার চেয়ে রাগ হয়েছিল বেশি। কিন্তু এই নড়াচড়া করতে না পারা অসহায় মানুষটার ওপর আর রাগ করতে পারিনি তখন।
সেদিন ঘরে আরও অনেকেই ছিলেন। পরে জেনেছিলাম, তারা ছিলেন উইলস সাহেবের পাওনাদার। গোটা বাড়িটা দখল নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। এদের সরাতে চেষ্টা করছে আবার ওপর তলার লোকেরা।
যারা দখল করতে চায় তারাই তার দেখাশোনা করতো। বিছানার পাশে এক গামলা বুটের ডাল রান্না, সাথে হয়তো কেউ চাপাতি(রুটি) এনে দিত। এ-ই ছিল তার খাওয়া। আর এভাবেই বেঁচে থাকা। এই হলো, নিষ্ঠুর অতীত। অতীত আর স্মৃতির ফারাকটা সব সময় ধরা যায় না I দুটোকেই সামলে চলা উচিত, বাড়াবাড়িতে কেবল কষ্টই বাড়ে।
- লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক