ডনবাসের যুদ্ধাঞ্চলে বিপুল হতাহতের শিকার ইউক্রেন, মরিয়া কিয়েভ আমেরিকার কাছে আরও অস্ত্র চাইছে
কাছেপিঠেই চলছে তুমুল লড়াই, শোনা যায় গোলা বিস্ফোরণের মুহুর্মূহ শব্দ। রণাঙ্গন থেকে অদূরেই অস্থায়ী সেনা হাসপাতাল। দ্রুত গতিতে চত্বরে এসে থামে একটি অ্যাম্বুলেন্স । ছুটে যায় একদল কর্মী; স্ট্রেচারে প্রথমেই নামানো হলো তরুণ এক আহত যোদ্ধাকে, তার চেহারা ফুলে গেছে, কাঁধ আর পিঠ বেয়ে ছুটছে রক্তের ধারা। গাড়ির ভেতর অন্য আহতদের অবস্থা আরও করুণ, ফয়েলের কম্বল ঢাকা অবস্থায় নিশ্চল পড়েছিল। আরও কয়েকজন যারা একটু কম আহত, পেছনের দরজা খুলে কোনোমতে বেড়িয়ে এসে মেডিকেল টিমের আনা হুইলচেয়ারে গা এলিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গেই তাদের নিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্রের দিকে ছুট লাগায় হাসপাতাল কর্মীরা।
চত্বরে টাঙ্গানো হয়েছে বেশকিছু তাঁবু, হতাহতের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেখানে মাঝেমধ্যে আহত সেনাদের রাখা হয়। এমন একটি তাঁবুর পাশে বেশকিছু রক্তাক্ত বিছানা দেখা যায়। হাসপাতালে আরো কয়েকজন আহত সেনা যারা চিকিৎসা নিয়েছে, তাদের ঘোরাফেরা করতেও দেখা যায়। সবার চেহারাই গম্ভীর, বিষণ্ণ। কারো বাহুতে; কারো মাথায় বা পায়ে বাঁধা ব্যান্ডেজ।
ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চল ঘুরে এ চিত্র তুলে ধরেছেন মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদক। এখানে রাশিয়ার সাথে প্রচণ্ড লড়াই চলছে। আক্রমণের মূল শক্তিও ডনবাসেই কেন্দ্রীভূত করেছে মস্কো। ক্রেমলিনের সর্বাত্মক শক্তি মোকাবিলা করতে গিয়েই দিশেহারা ইউক্রেনীয় যোদ্ধারা।
যেমন গত রোববার সকালে (২৯ মে) পূর্ব ইউক্রেনের ওই হাসপাতালে এক ঘণ্টার মধ্যে আনা হয় ১০ আহত সেনাকে। রাশিয়ার সমর শক্তির তুলনায় পূর্বাঞ্চলে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়া ইউক্রেনীয় বাহিনী ডনবাস যুদ্ধের সন্ধিক্ষণে এভাবেই হারাচ্ছে জনবল।
রাশিয়ার হামলার লক্ষ্যবস্তু হবে এই শঙ্কায় ওই হাসপাতালের সুনির্দিষ্ট ঠিকানা গোপন রেখেছে ওয়াশিংটন পোস্ট।
হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক ও সেনা সদস্য ২৯ বছরের যুবক ভ্লাড। তিনি পোস্টকে বলেছেন, "গত সপ্তাহে আমার ব্যাটালিয়নের ৭০ জন আহত হয়। অনেক বন্ধুকে চিরতরে হারিয়েছে, খুব কঠিন সময় পার করছি আমরা সবাই। জানি না আর কতজনকে এভাবে হারাতে হবে…. প্রতিদিন অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।"
রুশ সেনারা এত ভারী গোলাবর্ষণ করেছে যে, সেই শব্দে রোববার পুরো রাত (শনিবার দিবাগত) দুচোখের পাতা এক করতে পারেননি এই সৈনিক। তার মতে, "আহত যারা আসছে তাদের বেশিরভাগ গোলার শার্পনেল বা ধাতব টুকরোয় আহত হয়েছে। শত্রু আর কাছে আসছে না। পরিখায় (ট্রেঞ্চ) অবস্থান করা আমাদের বেশিরভাগ সেনা এখন শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। তবে দূরপাল্লার আঘাতের শিকার হচ্ছে।"
ডনবাস অঞ্চলে ইউক্রেনীয় সেনাদের অবস্থা ক্রমে সঙ্গিন। দিন দিন এগিয়ে আসছে রুশ সেনাবাহিনী। গেল সপ্তাহে ভ্লাডের ব্যাটালিয়নের তরুণ সেনারা রুশ বাহিনীকে ঠেকাতে নতুন একটি পরিখা খুঁড়ে সেখানে অবস্থান নেয়। কিন্তু, এখন তারাই হতাহত হয়ে আসছে হাসপাতালে। অথচ রুশ বাহিনী এ প্রতিরোধ ভেঙ্গে এগিয়ে গেলে তা ডনবাস এলাকায় যুদ্ধের মোড় মস্কোর পক্ষে ঘুরিয়ে দেবে।
কূটনৈতিকভাবেও হঠাৎ বেকায়দায় পড়েছে কিয়েভ। রুশ বাহিনী ইউক্রেনের যেসব অংশ দখল করেছে সেসবের ওপর মস্কোর নিয়ন্ত্রণকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলছেন পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি। ইউক্রেনকে ভারী অস্ত্রের আরও চালান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে দুই-তিন সপ্তাহ ধরে ভাবনাচিন্তায় কালক্ষেপণ করছে আমেরিকার বাইডেন প্রশাসন। অথচ মার্কিন অস্ত্র-সরঞ্জাম ছাড়া যুদ্ধের এই ক্রান্তিলগ্নে যুদ্ধের শক্তি হারাচ্ছে ইউক্রেন।
ইউক্রেনীয় ওই ব্যাটালিয়নের এক বোহদান নামক এক সেনা কর্মকর্তা বলেন, "আমরা সবাই ক্লান্ত। তবে শেষপর্যন্ত ইউক্রেনের মাটি শত্রুমুক্ত রাখার লড়াই চালিয়ে যাব।"
সাম্প্রতিক সময়ে, রুশ সেনারা ডনবাসের ভিটলোদার্সক ও লিমেন শহর দখল করে এগিয়ে এসেছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সেভারদনেৎস্ক দখলে। আঞ্চলিক যোগাযোগের কেন্দ্র এ শহর, এর সীমানায় অবস্থিত একটি হোটেলেও প্রবেশ করেছে তারা। শহরটির নিয়ন্ত্রণ রুশ বাহিনী নিতে পারলে পূর্বের লুহানস্ক প্রদেশ সম্পূর্ণরুপে তাদের দখলে চলে যাবে। এতে ডনবাসের প্রায় অর্ধেক এলাকা পেয়ে যাবে মস্কো।
বোহদান পরিস্থিতি সম্পর্কে রাখঢাক না করেই বলেন, "আশা করি সেভেরদনেৎস্কে আমাদের সহযোদ্ধারা শত্রু-বেষ্টিত হয়ে পড়বে না। তাদের আরও অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রয়োজন।"
মার্কিন প্রশাসনের প্রতি আরও সাহায্যের আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, "আরও অস্ত্র দিয়ে আমাদের সাহায্য করুন। সবচেয়ে বেশি দরকার বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র। ইউক্রনের আকাশে নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করুন, কারণ স্থল ও আকাশপথে রাশিয়ার হামলায় বেসামরিক মানুষই সবচেয়ে বেশি দুর্দশায় রয়েছে।"
গত ফেব্রুয়ারিতে যখন ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন পূর্বাঞ্চলেই সবচেয়ে জোর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল ইউক্রেনীয় বাহিনী। বর্তমান পরিস্থিতি ইঙ্গিত দেয়, তাদের সে বাধা ভেঙ্গে পড়ছে। রুশ বাহিনীর রণ প্রস্তুতি ও মাঠপর্যায়ে ব্যবস্থাপনা দুর্বল থাকায় তখন ইউক্রেন ও পশ্চিমা দুনিয়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের আশাও করেছিল।
সেই চিত্র এখন বদলে দিয়েছে রাশিয়া। নতুনভাবে সেনাশক্তি সংগঠিত করে ডনবাসের সামরিক অভিযানে ধারাবাহিক অগ্রগতি করছে রুশ সেনারা। ব্যবহার বাড়িয়েছে দূরপাল্লার কামান, রকেট এবং অগ্নিগোলক ছুঁড়ে দেওয়া ফ্লেমথ্রোয়ার অস্ত্রের। ইউক্রেনীয় বাহিনীর কাছে এসব সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে।
ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ রুশ বাহিনীর অগ্রযাত্রার গতি কিছুটা কমাতে পারলেও, ধীরে ধীরে ডনবাসের সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ কেন্দ্রটি ঘেরাও হয়ে পড়ছে। রাশিয়ার আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অঞ্চলটিতে ইউক্রেনীয় সেনাদের রসদ সরবরাহের লাইন।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা স্বীকার করে গত শনিবার এক ভিডিও বার্তায় ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি বলেন, "ডনবাসের রণাঙ্গনের পরিস্থিতি খুব কঠিন হয়ে উঠেছে। শত্রু গোলন্দাজ বাহিনী ও সেনা রিজার্ভের সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিয়ে আক্রমণ করছে।"
"আমাদের প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের যে সামর্থ্য- তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে মাতৃভূমি রক্ষার লড়াই করছি। সেনাদের সহায়তা পাঠাতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি- অবশ্যই তাতে সফলও হব। দখলদার শক্তি যদি মনে করে, লিমেন বা সেভেরদনেস্ক তাদের হবে- তবে তারা প্রচণ্ড ভুল করছে। ডনবাস ইউক্রেনেরই থাকবে।"
এদিকে গত এক সপ্তাহকালের বেশি সময় ধরে আমেরিকার কাছে এমএলআরএস- এর মতো ভারী ও দূরপাল্লার রকেট আর্টিলারি সরবরাহের অনুরোধ করছেন জেলেনস্কিসহ তার প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা। এই অস্ত্র পেলে অনেক দূর থেকে রুশ অবস্থানে আঘাত হানতে পারবে কিয়েভের অনুগত বাহিনী। ফলে পূর্বাঞ্চলে আরও জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে তারা।
বাইডেন প্রশাসন ও মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ কংগ্রেসের কর্মকর্তারা গেল শুক্রবার ওয়াশিংটন পোস্টকে জানান, এ সপ্তাহেই ইউক্রেনকে অস্ত্রটি সরবরাহ করা হতে পারে। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে হোয়াইট হাউস।
হোয়াইট হাউসের কিছু কর্মকর্তা অবশ্য আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, ১৮০ মাইল দূরে আঘাত হানতে সক্ষম এমএলআরএস সিস্টেম ইউক্রেনকে দেওয়া হলে, এটি দিয়ে তারা রাশিয়ার সীমান্তের ভেতরেও আঘাত হানতে পারে- এতে পাল্টা প্রতিশোধ নিতে পারে রাশিয়া। তবে আরও দূরপাল্লার রকেট সরবরাহ না করে আপাতত সেই ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বলে আশা করছে বাইডেন প্রশাসন।
- সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট