'বায়রাক্তার টিবি-২' ড্রোন কিনতে কেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে বিশ্ব?
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে একটি বিশেষ ড্রোন ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়েছে। তুরস্কের তৈরি এই ড্রোনটি এতটাই কার্যকর যে এর বদৌলতেই প্রতিপক্ষ রাশিয়াকে বারবার ঘোল খাইয়ে দিচ্ছে ইউক্রেন।
ইউক্রেনের সফলতায় অনুপ্রাণিত হয়ে এবার বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোও হুমড়ি খেয়ে পড়ছে তাদের সেনাবাহিনীর জন্য বিধ্বংসী এই আকাশচর অস্ত্রটি কিনতে। আর এ খবর জানিয়েছেন, 'বায়রাক্তার টিবি-২' নামক ড্রোনটির স্রষ্টা নিজেই।
বার্তা সংস্থাকে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে 'বায়রাক্তার টিবি-২' ড্রোনের নকশাকারক সেলজুক বায়রাক্তার বলেন, "এখন সারা বিশ্বই আমার ক্রেতা।"
সম্প্রতি আজারবাইজানে একটি প্রদর্শনীতে বায়রাক্তার বলেন, "বায়রাক্তার টিবি-২ ঠিক তার নিজের কাজটিই করছে- বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী কিছু আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, সাঁজোয়া যান এবং অত্যাধুনিক অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংস করছে।"
১৯৮০র দশকে সেলজুক বায়রাক্তারের বাবা ওজদেমির বায়রাক্তার ইস্তানবুলে 'বাইকার টেকনোলজিস' প্রতিষ্ঠা করেন। গত বছর ওজদেমির ৭২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করে। তার মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠানটির চীফ ইঞ্জিনিয়ার পদে বহাল হন তার ছোট ছেলে সেলজুক। সেলজুকের আরো একটি পরিচয় হলো, তিনি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের মেয়ের জামাই।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পুরো সময়টাই ড্রোন ব্যবহার করে রাশিয়ান ট্যাংক ও বাক মিসাইল লঞ্চার ধ্বংস করেছে ইউক্রেন। বায়রাক্তার টিবি-২ ড্রোন আকাশে ২৫,০০০ ফুট উপরে পর্যন্ত উঠতে পারে এবং শত্রুপক্ষের উপর বৃষ্টির মতো লেজার-গাইডেড রকেট ছুঁড়তে পারে।
রাশিয়ান সৈন্যদের প্রতিরোধে ড্রোনগুলো এতটাই কার্যকরী হয়েছে যে, ইউক্রেনের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা ও প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উপদেষ্টা, মিখাইল পোডোলিয়াক গত মার্চে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি পোস্টে ড্রোনগুলোকে 'সুপার-অস্ত্র' বলে আখ্যা দিয়েছেন। পোডোলিয়াকের ভাষ্যে- অস্ত্রগুলো রাশিয়ান ট্যাংকগুলোকে 'নিখুঁতভাবে পুড়িয়ে দিয়েছে।'
পোডোলিয়াক আরো বলেন, "এগুলো (শত্রুর ট্যাংক) জ্বলতেই থাকবে, কারণ বায়রাক্তারের (ড্রোন) কাজই হলো সুনিপুণ দক্ষতায় অদৃশ্য থেকে, ভয়ঙ্করভাবে, ধ্বংসাত্বকভাবে এটি করা ।"
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে নিজের তৈরি ড্রোনের ব্যাপক ব্যবহার দেখে বেশ সন্তুষ্ট এর স্রষ্টা সেলজুক বায়রাক্তার। বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেন, "এটা একটা অবৈধ আগ্রাসন, তাই আমাদের তৈরি ড্রোন ইউক্রেনের মানুষদের বাঁচাতে এবং তাদের দেশ রক্ষা করতে সাহায্য করছে।"
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে ড্রোনটির অভাবনীয় সাফল্য আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা বৃদ্ধি করেছে। রয়টার্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বায়রাক্তার টিবি-২ ড্রোন সিরিয়া, লিবিয়া ও ইরাকের সংঘাতপূর্ণ এলাকাগুলোতে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং একই সাথে এটি তুরস্কের প্রতিরক্ষা অস্ত্র রপ্তানির মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর আগে গত মাসে অনলাইন সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান লাইভস টিভি আয়োজিত একটি উদ্যোগে লিথুয়ানীয় নাগরিকরা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর জন্য টিবি-২ ড্রোন কিনতে ৫ মিলিয়ন ডলার চাঁদা সংগ্রহ করে। মাত্র তিনদিনে সাধারণ লিথুয়ানীয় নাগরিকদের কাছ থেকে এই অর্থ সংগ্রহ করে তারা।
ট্যাক্সি ড্রোন: শহরের অভ্যন্তরে পরিবহন ব্যবস্থায় বিপ্লব
বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে সেলজুক বায়রাক্তার জানান, অত্যাধুনিক ও উন্নত অস্ত্র প্রযুক্তির পাশাপাশি শহরের অভ্যন্তরে পরিবহন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনার জন্য 'ট্যাক্সি ড্রোন' নিয়ে কাজ করছে তার প্রতিষ্ঠান।
তিনি বলেন, "আপনি যদি দীর্ঘ সময়ের বিষয়টি ভাবেন, সেক্ষেত্রে আমরা ট্যাক্সি ড্রোন বানাতে কাজ করছি। তার জন্য দরকার অনেক উচ্চমানের স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। কিন্তু এটা শহরগুলোতে পরিবহন ব্যবস্থায় বিপ্লব আনবে।
তবে ইউক্রেনে বায়রাক্তার ড্রোনের ব্যবহার যে অস্ত্র প্রযুক্তির ইতিহাসে বাইকার টেকনোলজিসের নাম নতুনভাবে পরিচয় করিয়েছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
বায়রাক্তার জানান, তার প্রতিষ্ঠান এখন টিবি-২ ড্রোনের আগামী সংস্করণ নিয়ে কাজ করছে- যার নাম টিবি-৩ এবং এর মধ্যে থাকবে ফোল্ডেবল উইং বা ভাঁজ করা যায় এমন ডানা। এছাড়া, প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবিত অন্য ড্রোনগুলোও চমৎকার পারফরমেন্স দেখিয়েছে।
বাইকার টেকনোলজিস এর চালকবিহীন আকিনচি ড্রোনের আকার-আকৃতি টিবি-২ এর চেয়ে অনেক বড়। সম্প্রতি এটি অদৃশ্যভাবে (রাডার ফাঁকি দেওয়া বোঝাতে) ফ্লাইট পরিচালনা করে তুরস্ক থেকে আজারবাইজান পৌঁছেছে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পাঁচ ঘন্টার এই যাত্রায় ড্রোনটি তিনটি দেশের মধ্যে দিয়ে ১২০০ মাইলেরও বেশি পথ পাড়ি দিয়েছে।
সূত্র: ইনসাইডার
আরও পড়তে পারেন: