এ বছর চট্টগ্রাম বন্দর সীমানায় ঘটেছে ৩টি দস্যুতার ঘটনা: রিক্যাপ
রিজিওনাল কোঅপারেশন অ্যাগ্রিমেন্ট অন কমব্যাটিং পাইরেসি অ্যান্ড আর্মড রবারি এগেইন্সট শিপস ইন এশিয়া- রিক্যাপ এর প্রতিবেদন অনুসারে, কয়েক বছর ধরে জলদস্যুতামুক্ত থাকার পর চট্টগ্রাম বন্দরে এ বছর তিনটি জলদস্যু হামলার ঘটনা ঘটেছে।
২০২১ সালে এশিয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর দস্যুতামুক্ত হয়। তবে চট্টগ্রাম বন্দরের সেই সফলতা বেশিদিন টিকেনি।
রিক্যাপের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৫ মার্চ অয়েল ও ক্যামিকেল ট্যাংকার ওয়াওয়াসান টোপাজ, ১৬ এপ্রিল এলএনজিবাহী জাহাজ বিএলপিজি সোফিয়া এবং ২৬ এপ্রিল পেট্রোলিয়াম ক্যামিকেলবাহী এসটিআই ম্যাজিস্টার জাহাজে দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে।
চলতি বছরে ২৮ মে পর্যন্ত ৩৯টি দস্যুতার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে রিক্যাপের প্রতিবেদেনে। এর মধ্যে বাংলাদেশে ৩টি, ভারতে ৩টি, ফিলিপাইনে ৩টি, মালাক্কা প্রনালী ও সিঙ্গাপুরে ২৫টি এবং ইন্দোনেশিয়াতে ৫টি দস্যুতার ঘটনা রেকর্ড করা হয়।
দস্যুতার ঘটনাগুলোকে চারটি ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত করা হয় রিক্যাপের প্রতিবেদনে। চট্টগ্রাম বন্দরে ৩টি দস্যুতার ঘটনা রেকর্ড করা হয় ক্যাটাগরি ৪ এ।
ক্যাটাগরি ৪ এর এর আওতায় দস্যুতার ধরনকে এভাবে উল্লেখ করা হয় রিক্যাপের প্রতিবেদনে: অপরাধীরা সশস্ত্র ছিল না এবং কোনো ক্রুদের ক্ষতি হয়নি। ক্যাট ফোর এর অধীনে থাকা ঘটনার অর্ধেকেরও বেশি ঘটনায় ১ থেকে ৩ জন জড়িত যারা ক্রুদের চোখে পড়ার পরেই পালিয়ে যায়।
মেরিটাইম বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জল করতে কোস্ট গার্ডের টহল বৃদ্ধি, ট্র্যাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করা, বহির্নোঙ্গরে অনুমোদনহীন জাহাজের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ, জাহাজে ওয়াচম্যান সরবরাহ, বন্দর ইয়ার্ডে ১ হাজার ২৫০টি সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ বেশি কিছু পদক্ষেপ নেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। টহল দেওয়ার সীমানাও ৭ নটিক্যাল মাইল থেকে বাড়িয়ে ৬৫ নটিক্যাল মাইল করা হয়।
বন্দর কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, জলসীমার উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকায় নজরদারি করে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড। দেশের সমুদ্রসীমার বাকি অংশ নজরদারি করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের (পূর্ব জোন) কমান্ডার এম আশফাক বিন ইদ্রিস বলেন, "চট্টগ্রাম বন্দর সীমানায় বিদেশি জাহাজে চুরির ঘটনা ঘটে। তবে সেগুলো ৬ থেকে ৭ ঘণ্টার মধ্যে উদ্ধার করে জাহাজ কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। রিক্যাপের প্রতিবেদনে ঘটনার বর্ণনায় বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে।"
তিনি আরো বলেন, সমুদ্রে সার্বক্ষণিক কোস্ট গার্ডের ২টি জাহাজ এবং ৬ থেকে ৭টি জাহাজ টহল পরিচালনা করে।
বন্দরের সুরক্ষা বাড়াতে ২০১৩ সালে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সুইডেন থেকে আমদানি করা হয় ভিটিএমএস পদ্ধতি। এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর সীমানার ১০ নটিক্যাল মাইল অংশ ভিডিও মনিটরিংয়ের আওতায় চলে আসে।
মনিটরিংয়ের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের পুরো চ্যানেল ও তার আশপাশের এলাকা ঘিরে পতেঙ্গা, বন্দর ভবন, সদরঘাট, রুবি গেইট, আনোয়ারাসহ বিভিন্ন স্থানে ৪৬টি অতি-ক্ষমতাসম্পন্ন ভিডিও ক্যামেরা (আইআর) স্থাপন করা হয়।
এছাড়া ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে কুতুবদিয়া, মাতারবাড়ি, সীতাকুণ্ড এলাকায় আরো ১০০টি আইআর ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগও নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এত সব উদ্যোগের পরও কেন চট্টগ্রাম বন্দরে এ বছর তিনটি দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম বন্দরের ডেপুটি কনজারভেটর ক্যাপ্টেন ফরিদুল আলম বলেন, "আমরা রিক্যাপের প্রতিবেদন নিয়ে দ্বিমত পোষণ করছি। আমরা এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে শিগগিরই রিক্যাপ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেব।"
নষ্ট হতে পারে চট্টগ্রাম বন্দরের ভাবমূর্তি
চট্টগ্রাম বন্দর আগামী জুলাইতে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল চালু করতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ইউরোপের দেশ ইতালি, নেদারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য রুটে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু করেছে। আরো কয়েকটি রুটে শিগগিরই চালু হবে সরাসরি জাহাজ চলাচল। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে দস্যুতার ঘটনা বন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মেরিটাইম বিশ্বে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বন্দরের স্টেক হোল্ডার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক সাহেদ সরওয়ার বলেন, "আগের বছরগুলোতে বন্দর দস্যুতামুক্ত হওয়ায় ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম সেক্টরে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিলো। তবে চলতি বছর তিনটি দুস্যতার ঘটনা অবশ্যই এই অর্জনকে পিছিয়ে দেবে। নিশ্চই নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ঘাটতি ছিলো। বন্দরের পূর্বের অর্জনের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখতে বন্দর সীমানায় নিরাপত্তা আরো জোরদার করতে হবে।"
তবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এই তিনটি দুস্যুতার ঘটনা সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করছে। কর্তৃপক্ষ বলছে কেন রিক্যাপের প্রতিবেদনে এই তিনটি ঘটনা অন্তভূক্ত হলো তা তাদের বোধগম্য নয়। শিগগিরই রিক্যাপ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেবে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
রিক্যাপের তথ্য অনুযায়ী, সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম বন্দর শতভাগ দস্যুতামুক্ত হয় ২০১৯ সালে। এরপর ২০২০ সালে মাত্র একটি দস্যুতার ঘটনা ঘটেছিলো। ২০২১ সালে আবারো দস্যুতামুক্ত বন্দর হিসেবে সুখ্যাতি পায় চট্টগ্রাম।
এর আগে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর (আইএমবি) ২০০৬ সালের একটি প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম বন্দরকে জলদস্যু আক্রমণের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক বন্দর ঘোষণা করা হয়। ওই বছর চট্টগ্রাম বন্দরে দস্যুতার ঘটনা ঘটেছিল ৪৭টি।
একের পর এক দস্যুতার ঘটনায় ওই সময়ে পৃথিবীজুড়ে চট্টগ্রাম বন্দরের নেতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়। এর ফলে অনিরাপদ মনে করে বিদেশি জাহাজগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে অস্বীকৃতি জানাত।
আর যেসব জাহাজ আসত, ঝুঁকির বিবেচনায় সেগুলোও নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া নিত। ফলে আমদানি ও রপ্তানি খরচ পড়ত বেশি। এর প্রভাব পড়তো পণ্যবাজারে।
২০০০ প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বন্দর কোস্টগার্ডকে দুটি পেট্রোল বোট দেওয়া হয়। এসব পেট্রোল বোট দিয়ে বন্দর চ্যানেলে নজরদারি বাড়ায় কোস্ট গার্ড। কোনো ধরনের দস্যুতার ঘটনা ঘটলে দ্রুত উপস্থিত হতে পারত কোস্ট গার্ড। এরপর থেকে কমতে থাকে বন্দরের দস্যুতার ঘটনা।
২০১২ সালের জানুয়ারিতে আইএমবি ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে তাদের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জলদস্যুপ্রবণ দেশের তালিকা থেকে বাদ দেয়। নিরাপত্তা পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে কমতে থাকে জাহাজের ভাড়া ও ইনস্যুরেন্সের প্রিমিয়ামও।