ইনক মি: ঢাকায় ট্যাটুর জগতে আমন্ত্রণ
স্কুলপড়ুয়া এক বালক। প্রায়ই টিভিতে রেসলিং শো (ডব্লিউডব্লিউই) দেখত। একসময় পছন্দের রেসলিং খেলোয়াড়দের দেহজুড়ে নানারকম উল্কি (ট্যাটু) দেখে নিজেও ট্যাটু আঁকার তীব্র উৎসাহ বোধ করলো।
তারপর কেটে গেছে কয়েক বছর… বড় হয়ে শুধু নিজের দেহে ট্যাটু একেই ক্ষান্ত হননি, দেশে একটি ট্যাটু স্টুডিওই দিয়ে বসে সেই ছেলে। আইন বিভাগে পড়াশোনা করলেও তা ছেড়েছুড়ে এখন চালিয়ে যাচ্ছেন শখের সেই স্টুডিওটিই। এভাবেই বাংলাদেশের প্রথম ট্যাটু আর্ট প্রতিষ্ঠান 'ইনক মি ট্যাটু স্টুডিও ঢাকা'র যাত্রা শুরু।
'ইনক মি ট্যাটু স্টুডিও ঢাকা'র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন সাজাদুল ইসলাম মুন, যার ছোটবেলার স্বপ্নকে তিনি বাস্তবে রূপ দিয়েছেন, অন্যজন হচ্ছেন নঈম মাহমুদ। নঈম একজন ফ্রিল্যান্সিং ট্যাটু আর্টিস্ট। দু'জনের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ট্যাটু, সেখান থেকেই তাদের পরিচয়। ট্যাটুর প্রতি গভীর টান থেকেই দু'জনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারপর দু'জনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন ঢাকার মধ্যে ট্যাটু স্টুডিও খুলবেন। সময়টা আজ থেকে ৭ বছর আগে। তখন এ বিষয়ে লোকের তেমন একটা ধারণা ছিল না বললেই চলে।
আগ্রহ বাড়ছে তরুণদের
উম্মে তিশা পড়াশোনা করছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিক বিভাগে। বাবা-মায়ের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিজের শখ পূরণে ডান হাতের কব্জির নিচে এককোণে ছোট তারকা বিশিষ্ট উল্কি করিয়েছেন।
উম্মে তিশা বলেন, "বলিউড অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার হাতে ট্যাটু দেখে আমার ইচ্ছে জাগে। কিন্তু অনেকের মতো আমারও চিন্তা ছিলো আমাদের দেশে ট্যাটু করলে সেটা ঠিকঠাক হবে কিনা, বা আদৌ সেটা ত্বকের ক্ষতি করবে কিনা। কিন্তু ট্যাটু করার পর আমার বেশ পছন্দ হয়। আমার এটা দেখার পর আমার দুইজন বন্ধুও নিজেদের শরীরে ট্যাটু করে।
প্রথমবার এটা করতে যেয়ে বেশ ভয় কাজ করছিলো। তবে সুঁই দিয়ে ডিজাইন করার সময় যতটা ব্যথা পাবো ভেবেছিলাম অতোটাও লাগেনি"।
বর্তমান প্রজন্মের অনেকের হাতে, কাঁধে ও দেহের বিভিন্ন অংশে উল্কি আঁকা দেখতে পাওয়া যায়। সংগীতশিল্পী থেকে শুরু করে অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, নৃত্যশিল্পীরাও ইদানীং নিজেদেরকে অন্যদের চেয়ে ভিন্নভাবে উপস্থাপন ও আলাদা করে তুলতে দেহে উল্কি আঁকছেন। তবে অন্য দেশগুলোর তুলনায় আমাদের দেশে এই প্রবণতা এখনো অনেক কম। বর্তমানে র্যাপসংগীত শিল্পীদের মধ্যে উল্কি আর্ট বেশি দেখতে পাওয়া যায়। কেউ করেন নিজেদের পছন্দের নকশা ও স্মৃতি থেকে ট্যাটু। কেউবা আবার হালের ফ্যাশনের সাথে মিলিয়ে দেহের বিভিন্ন অংশ রঙে, নকশায় ফুটিয়ে তুলতে চায়।
মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি
নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে সাজাদুল ইসলাম মুন বলেন, "খুব কম মানুষ এখনো একে স্বাভাবিকভাবে নিতে পেরেছে। শরীরে ট্যাটু করা দেখলেই লোকের মধ্যে নানা গৎবাঁধা চিন্তা কাজ করে। এমনকি নানারকম কুসংস্কার আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে এ নিয়ে। আমাদের এই কাজকে বাঁকা চোখে দেখা হয়। অনেকে ভাবতেই পারেন না এটা কোন পেশা হতে পারে। কিন্তু আমরা তো কাউকে বাধ্য বা জোরাজুরি করে উল্কি একে দিচ্ছি না। যাদের এটা নিয়ে আগ্রহ ও ভালোলাগা রয়েছে তারাই নিজ থেকে আসছেন"।
"আমাকে কতশত বার এইরকম ঘটনার মধ্যে পড়তে হয়েছে তার হিসেব নেই। রাস্তায় হঠাৎ কোন লোকের চোখে পড়লো আমার হাতে ট্যাটু করা আছে, ব্যাস চটে গিয়ে ধর্মীয় বাণী ও নানা কিছু বলতে শুরু করে দিলো।"
ট্যাটু করতে চাইলে
শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠান চালু করতে গিয়ে বেশ নাজেহাল অবস্থায় পড়তে হয়েছিল 'ইনক মি ট্যাটু স্টুডিও ঢাকা'র প্রতিষ্ঠাতাদের।
বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে দোকান ভাড়া নিতে চেয়েও মিলেনি। কেননা ট্যাটু স্টুডিওকে কেউ লাভজনক ব্যবসা তো দূরের কথা, পেশা হিসেবেই ভাবতে পারতো না। তারপর সেখান থেকে তারা বেইলি রোডের একটি মার্কেটে 'ঢাকা ট্যাটু স্টুডিও' নামে প্রতিষ্ঠান খুলে বসেন। দু'বছর পর তার পাশেই নতুন ভবন মার্কেট 'ফিয়েস্তা' চালু হলে ট্যাটু স্টুডিওটি সেখানে স্থানান্তর করা হয়। সে সময় নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ' ইনক মি ট্যাটু স্টুডিও ঢাকা'। 'ইনক মি' অর্থ হচ্ছে 'আমাকে রাঙিয়ে দাও'। ট্যাটু করতে নানা রঙের সংমিশ্রণে ব্যক্তির দেহের নির্দিষ্ট কিছু অংশ নকশায় রাঙিয়ে তোলা হয় তাই এই নাম দেওয়া।
মুশকিল হচ্ছে, ট্যাটুর কালি থেকে সুঁই বা কালি রাখার পাত্র যেটাকে 'ইনক আপ' বলা হয় তার কোন কিছুই আমাদের দেশে তৈরি হয় না। তাই যারা এই ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের সবকিছু বাইরে থেকে যেমন- ইউরোপ, আমেরিকার মতো দেশগুলো থেকে আমদানি করে আনতে হয়।
'ইনক মি ট্যাটু স্টুডিও ঢাকা' প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ২জন ট্যাটু শিল্পী রয়েছেন। একজনের নাম সুদীপ্ত, আরেকজন মিনহাজ। তারা দুজনেই এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। পূর্বে যখন প্রতিষ্ঠানটি চালু হয় তখন বাংলাদেশে ট্যাটু শিল্পী তেমনভাবে কেউ ছিলনা। তাই ভারতের ২জন ট্যাটু আর্টিস্টকে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠাতারা ভাবেন অন্যদেশ থেকে নয়, নিজ দেশের আগ্রহীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আর্টিস্ট গড়ে তুলবেন। তারপর থেকে প্রতিষ্ঠানটি উল্কি আঁকার পাশাপাশি প্রশিক্ষণও দিয়ে আসছে।
উল্কি শিল্পী সুদীপ্ত একজন চিত্রশিল্পীও। ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসতেন। চারুকলায় পড়াশোনার পর ভাবলেন উল্কি শিল্পী হবেন। 'ইনক মি ট্যাটু স্টুডিও ঢাকা' থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সেখানেই পেশাজীবনের সূচনা করেন। সুদীপ্ত তার পেশাজীবনের চার বছরে ৩ হাজার ব্যক্তির দেহে উল্কি করে দিয়েছেন। তিনি নিজের বাঁ হাতেরও অনেকটা জুড়ে উল্কি করেছেন, যেখানে রয়েছে হিন্দু ধর্মের মহাদেব শিবের একটি বাণী।
দরজা টেনে স্টুডিওটির ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো কিছু দেয়ালচিত্র। শিল্পী সুদীপ্ত জানালেন এগুলো তার নিজের আঁকা। পুরো স্টুডিওটি নিজের আঁকা ছবি দিয়ে সাজিয়ে তুলতে কাজ করছেন তিনি। ভেতরে আরও চোখে পড়লো বিভিন্ন রঙের কালি ও উল্কি করার ইলেকট্রিক মেশিন। আর্টিস্ট সুদীপ্ত দেখাচ্ছিলেন কীভাবে কোন মেশিনে সুঁই বসিয়ে কারুকার্য করা হয়।
ট্যাটু ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথম ইলেকট্রনিক মেশিন কয়েলের আবির্ভূত হয়। তারপর রোটারি মেশিন ও শেষে অর্থাৎ বর্তমানে পেন মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে। রোটারি মেশিনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি ওজনে ভারি ও চালু দেওয়ার পর বেশ শব্দ করে। দীর্ঘ সময় ধরে ট্যাটু করতে থাকা ব্যক্তির মাথাব্যথা শুরু করার মতো অবস্থা হয়ে যায় এই মেশিনের অতিরিক্ত শব্দে। সে তুলনায় পেন মেশিন কলমের মতো হালকা ও এর মাথার অগ্রভাগে সুঁই বসিয়ে নকশা করা হয়। সূক্ষ্ম নকশার ক্ষেত্রে প্রথমে স্টেনসিল পেপারে ছাপ নিয়ে দেহে বসানো হয়। তারপর মেশিন যোগে সুঁই দিয়ে নকশা করা হয়। পাশেই ছোট টেবিলে রাখা হয়েছে বিভিন্ন আকারের ইনক আপ। এগুলোতে রঙ রাখা হয় এবং সেখান থেকে সুঁইয়ের মাথায় রঙ ভরিয়ে কাজ করা হয়। রঙের ক্ষেত্রে রয়েছে নানারকম ঘনত্ব। তাই ট্যাটু করার সময় ঘনত্বের কমবেশি করতে ডিসটিলড ওয়াটার মেশানো হয়।
'ইনক মি ট্যাটু স্টুডিও ঢাকা' প্রতিষ্ঠানে ক্ষুদ্র ট্যাটু ডিজাইন থেকে সমগ্র দেহ জুড়েই ট্যাটু ডিজাইন করা হয়। সেক্ষেত্রে ট্যাটু ডিজাইন বাবদ ফি নির্ধারণ করা হয় ট্যাটু দেহের কোথায় করা হবে, ট্যাটুর নকশা ও আকার কেমন হবে তার ওপর। তবে ক্ষুদ্র কোন ডিজাইন বা নামের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ফি নেওয়া হয় ৩ হাজার টাকা। এখন পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি মানুষ 'ইনক মি ট্যাটু স্টুডিও ঢাকা' থেকে ট্যাটু করিয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন সরকারি চাকরিজীবী থেকে শিক্ষার্থী ও নানা পেশার লোকজন।
সাজাদুল ইসলাম মুন বলেন, "ট্যাটু করতে আসা বেশিরভাগ মানুষ তাদের প্রিয়জনদের নাম, কোন নির্দিষ্ট তারিখ, বাবা-মার স্কেচ, পোর্ট্রেট ও নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি মনে রাখতে ট্যাটু করে থাকেন। ট্যাটু করার ক্ষেত্রে আমাদেরকে আগে দেখতে হয় কোথায় করতে চাচ্ছে। কেননা শরীরের সব স্থানের ত্বক একইরকম হয় না। কিছু কিছু জায়গায় বেশ সাবধানতা ও সতর্কতার সাথে কাজ করতে হয়। আবার প্রত্যেকের স্কিন টাইপ আলাদা তাই সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডিজাইন জটিল ও বড় হলে তা করতে সময় প্রয়োজন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদেরকে কয়েকটি সেশনে তা করতে হয়। যেমন- হাতের অর্ধেক নকশা করতে ৮-১০ ঘণ্টা লাগে। কিন্তু তাও সেটা একটা সেশনে করা সম্ভব নয়। প্রতিটি সেশনের মাঝে ১ সপ্তাহের বিরতি রাখা হয়।"
ট্যাটুর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি 'পিয়ার্সিং' অর্থাৎ নাক, কান, ভ্রু, নাভি ও দেহের বিভিন্ন জায়গায় ছিদ্র করে রিং পড়ানোর সার্ভিস দিয়ে থাকে। যেখানে প্রতি কানের ছিদ্র করতে সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা ফি রাখা হয়। কিছুদিন হলো প্রতিষ্ঠানটি লেজার ট্রিটমেন্ট চালু করেছে। লেজারের মাধ্যমে পূর্বে করা ট্যাটু 'ভ্যানিশ' অর্থাৎ মুছে ফেলা সম্ভব হবে। কিন্তু বিষয়টি অনেকটা পীড়াদায়ক ও বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রায় ৫/৬টি সেশন প্রয়োজন একেকটি ট্যাটু মুছে ফেলার জন্য অর্থাৎ প্রায় বছরখানেক লেগে যাবে এটি করতে। এছাড়াও মাইক্রোব্লিডিং ট্রিটমেন্ট ও শ্বেতাঙ্গ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ত্বকের ভারসাম্য রক্ষায় রঙ ফিরিয়ে দেওয়ার সার্ভিসও এখানে দেওয়া হয়।
ট্যাটু কতটা ক্ষতিকারক
সাজাদুল মুন জানান, "আমাদের দেশের ডাক্তারদের অনেকেই বলে থাকেন ট্যাটু করলে স্কিন ক্যান্সার বা অন্যান্য সমস্যা হয়। কিন্তু আসলেই যদি ট্যাটু করলে এসব সমস্যা হতো তাহলে অন্যান্য দেশের লোকেরা ট্যাটু করতো না। কারণ তারা আমাদের থেকে অনেক বেশি সচেতন। তবে ট্যাটু করার পর কিছু সতর্কতা মেনে চলতে হয়। যেমন- ট্যাটু করা স্থানে প্রথম কিছুদিন ক্লোরিন ওয়াটার, সাবান, সমুদ্রের লবণাক্ত পানি, নখের আঁচড় দেওয়া যাবে না। ট্যাটু স্থানে ইনফেকশন দেখা দিলে আমরা তাদেরকে এন্টিবায়োটিক মলম ও পরিচিত ডাক্তার সুপারিশ করি। যদিও এমনটি খুব কম ব্যক্তির ক্ষেত্রেই ঘটেছে"।
"এমনকি আরেকটি ভ্রান্ত ধারণা অনেকের মধ্যে রয়েছে- যারা ট্যাটু করেন তারা অন্যদের রক্তদান করতে পারেন না। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল। আমি নিজে রেড ক্রিসেন্টে রক্ত দানকারী হিসেবে বহু বছর যাবত আছি। আমাদের দেশে ট্যাটু নিয়ে নানা ভুল ব্যাখ্যা ও ধারণা মানুষের মাঝে রয়েছে। এটা একটা শিল্প, আমরা শুধু সেটাকে তুলে ধরছি। এখানে আমরা কাউকে জোর করে যেমন কিছু করছি না, তেমনি আমরা কোন ধর্ম ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কাজ করছি না। আশা করি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে এধরনের ভুল ধারণা থাকবে না।"
ট্যাটু শিল্পের হাতেখড়ি ও শুরুটা 'ইনক মি ট্যাটু স্টুডিও ঢাকার' হাত ধরে হলেও বর্তমানে তা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। একাধিক ট্যাটু প্রতিষ্ঠান রয়েছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে। ঢাকার মধ্যে ওয়ারী, মিরপুর, ধানমন্ডি, যাত্রাবাড়ী ও বিভিন্ন জায়গায় ট্যাটু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। চট্টগ্রাম, সিলেটসহ ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলাতেও ধীরে ধীরে ট্যাটু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে।