ছিলেন নারী জাতীয় দলের তারকা খেলোয়াড়, হয়ে গেলেন সেনাবাহিনীর পুরুষ সৈনিক!
তিনি যে নারী- সেটি প্রমাণ করতে বেশ কয়েক বছর এপ্রিলিয়া সান্তিনি মাংগানাং ও ইন্দোনেশিয়ান নারী ভলিবল অ্যাসোসিয়েশনকে লড়তে হয়েছে; অথচ এ বছর নিশ্চিত হওয়া গেল, তিনি আসলে পুরুষ!
ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় নারী ভলিবল দলের সাবেক সদস্য মাংগানাং তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে নিজ দেশ ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন ক্লাবের হয়েও দারুণ খেলেছেন। তার অধিনায়কত্বে জাকার্তা ইলেক্ট্রিক পিএলএন নারী দল ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে প্রোলিগায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ২০১৯ সালেও জাকার্তা পিজিএন পপসিভো পলওয়ান দলকে চ্যাম্পিয়ন করেন তিনি। এরপর দলবদল করে নাম লেখান থাইল্যান্ডের জেনারেলি সুপ্রিম চনবুরি-ই টেক দলে। এ দলকে সে বছরই থাই ভলিবল লিগে তিনি চ্যাম্পিয়ন করেন।
ক্যারিয়ারে অনেকবার সেরা খেলোয়াড়ের পদক জয় করেছেন মাংগানাং। সাউথইস্ট এশিয়ান গেমসে ইন্দোনেশিয়ান জাতীয় দলকে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক এনে দিতেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবে তার দৈহিক গঠন ও চেহারার জন্য সেসব দুর্দান্ত অর্জন সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
চওড়া কাঁধ, পুরুষালি শারীরিক গঠন, অনুচ্চ বুক ও উঁকি দেওয়া গোঁফের রেখা- সব মিলিয়ে এপ্রিলিয়া মাংগানাংকে কখনোই দেখতে 'স্বাভাবিক' নারীদের মতো লাগেনি। বাতাসে তার লাফানোর ক্ষমতা ও বল স্ম্যাশ করার দাপট প্রতিপক্ষের কাছে তাকে 'মনস্টার অব দ্য ভার্টিক্যাল জাম্প' উপাধি এনে দিয়েছে। তবে একই সঙ্গে এটি তার প্রকৃত লৈঙ্গিক পরিচয় সম্পর্কেও জাগিয়েছে সন্দেহ।
২০১৫ সালে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত সাউথইস্ট এশিয়ান গেমসের আগে তাকে নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন ফিলিপাইন ভলিবল দলের কর্মকর্তারা। মাংগানাংয়ের লৈঙ্গিক পরিচয় পরীক্ষার দাবিও জানিয়েছিলেন তারা। কিন্তু সাউথইস্ট এশিয়ান গেমস ফেডারেশন সেই দাবি উড়িয়ে দিলে তার খেলতে আর কোনো বাধা থাকেনি।
'একজন স্প্রিন্টার ও ভলিবল খেলোয়াড় হিসেবে ক্যারিয়ারে বহুবার লৈঙ্গিক পরিচয় নিশ্চিতের পরীক্ষা দিয়েছি। এ ধরনের পরীক্ষা আবারও দিতে আমার কোনো ভয় নেই। এর জন্য আমি প্রস্তুত। আমি যেসব তথ্য দিয়েছি, সেগুলো যদি ভুল প্রমাণিত হয়, তাহলে নিজেকে সরিয়ে নেব,' তখন বলেছিলেন মাংগানাং।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে খেলা থেকে অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত মাংগানাংকে লৈঙ্গিক পরিচয় নিয়ে নানা সমালোচনা ও গুজবের শিকার হতে হয়। তবে তার আচমকা অবসর নেওয়ার খবর অনেককেই অবাক করেছিল। কেননা, তখনো ক্যারিয়ারের তুঙ্গে ছিলেন তিনি।
'ইন্দোনেশিয়ার সব ভলিবলপ্রেমীকে জানাতে চাই, আমি এপ্রিলিয়া মাংগানাং ভলিবল দুনিয়া থেকে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি,' তখন ইনস্টাগ্রামে লিখেছিলেন তিনি। আরও লিখেছিলেন, 'আমি আরও সুন্দর জীবন কাটাতে চাই, নিজের অন্তরের সত্যে শান্তিতে উপনীত হতে চাই বলেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই এটি আমার কাছে জীবনের একটি সেরা সিদ্ধান্ত।'
পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে অবসর নেওয়ার পর তিনি সামরিক বাহিনীতে ক্যারিয়ার শুরু করেন। আর্মি উইমেন'স কর্পসে যোগ দেন একজন সেকেন্ড সার্জেন্ট হিসেবে। অবশেষে নারী হিসেবে জীবনের ২৮টি বছর কাটানোর পর এখানেই প্রমাণ হয়, তিনি আসলে পুরুষ!
ইনডিপেনডেন্ট অবজারভার পত্রিকার সূত্রমতে, ইন্দোনেশিয়ার মানাদো শহরের রবার্ট ওয়াল্টার মংগিনসিদি আর্মি হসপিটালে পরীক্ষা নেওয়ার পর জানা যায়, এপ্রিলিয়া আসলে নারী নন। ওই হাসপাতালে পরীক্ষার যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে অধিকতর পরীক্ষার জন্য তাকে জাকার্তার গাতোত সুব্রত আর্মি সেন্ট্রাল হসপিটালে পাঠানো হয়। এরপর এ মাসে তার লৈঙ্গিক পরিচয় সম্পর্কে দেশটির সেনাবাহিনী একটি সুস্পষ্ট বিবৃতি প্রকাশ করে।
'সেকেন্ড সার্জেন্ট এপ্রিলিয়া সান্তিনি মাংগানাং নামে সেনাবাহিনীর একজন সৈনিক সম্পর্কে একটি তথ্য জানাতে চাই। এপ্রিলিয়া মাংগানাং আমাদের সবার মতো ভাগ্যবান নন। এ কারণে, জন্মগতভাবেই রিপ্রোডাকটিভ সিস্টেমে ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় এই ত্রুটিকে হাইপোস্পেডিয়াস বলা হয়,' জানান দেশটির সেনাপ্রধান আন্দিকা পারকাসা।
তিনি আরও জানান, 'ইউরোলজিক্যাল এক্সামিনেশন থেকে জানা গেছে, সার্জেন্ট মাংগানাংয়ের শরীরে পুরুষ সেক্স অরগানের পরিমাণ বেশি এবং এমনকি তার দেহে কোনো নারী ইন্টারনাল অরগান নেই।'
'এরপর হরমোনাল টেস্ট থেকেও একই রেজাল্ট পাওয়া গেছে। তার হরমোট টেস্টোস্টেরনও হিসেব করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, সার্জেন্ট মাংগানাংয়ের হরমোনাল লেভেল স্বাভাবিক পুরুষ ক্যাটাগরির সমতুল্য। এমআরআই রেডিওলজিক্যাল এক্সামিনেশন থেকেও একই তথ্য জানা গেছে,' বিবৃতিতে আরও জানান সেনাপ্রধান।
নিজের সত্যিকারের লৈঙ্গিক পরিচয়ের সঙ্গে খুব দ্রুতই মানিয়ে নিয়েছেন সাবেক ভলিবল তারকা মাংগানাং। নিজের নাম বদলে রেখেছেন আপ্রিলিও পারকাসা মাংগানাং। চুলে দিয়েছেন ছেলেদের কাট। পরছেন ছেলেদের পোশাক। এমনকি এ নিয়ে নিজের অভিমতও প্রকাশ করছেন এক বিবৃতিতে।
'এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। আমি ভীষণ খুশি। স্রষ্টাকে ধন্যবাদ, আমি এখন এই পরিচয় নিয়ে এগোতে পারব। আমাকে সাহায্য করার জন্য এবং আত্মপরিচয় খুঁজে দেওয়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ,' এক ভার্চুয়াল কনফারেন্সে বলেন মাংগানাং।
তিনি আরও বলেন, 'আমাকে সাহায্যকারী চিকিৎসকদের ধন্যবাদ। আমি খুবই খুশি। এ মুহূর্তের জন্য গত ২৮ বছর অপেক্ষায় ছিলাম। অবশেষে এটি ধরা দিলো।'
- সূত্র: অডিটি সেন্ট্রাল