যে মাংস খেতে পারবেন ভেজিটেরিয়ানরাও!
"আমি গত ১৯ বছর যাবত ভেজিটেরিয়ান (নিরামিষাশী) জীবনযাপন করছি। কয়েক সপ্তাহ আগে এই এতগুলো বছর পর আমি প্রথম কোন চিকেন নাগেটে কামড় বসাই- এর স্বাদ যেন আমাকে ছেলেবেলার ফাস্টফুডের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। বাইরে মুচমুচে অথচ ভেতরে নরম মাংসের টুকরো-সাথে গরম গরম সস তো আছেই", বলেন জন এমন্ট।
স্বাদে তফাত না থাকলেও এমন্টের ছেলেবেলার মুরগি আর এই নাগেটের মুরগি এক নয়। এই মুরগির না আছে কোন পাখা, না পাখা ঝাপটানোর পালক! বিশেষভাবে তৈরিকৃত এই মুরগির কোষগুলোকে প্রথমে একটি পুষ্টি দ্রবণে ডোবানো হয়; এরপর বায়োরিএকটরের মাধ্যমে এর পুনরুৎপাদন হতে থাকে। এক্ষেত্রে রক্তমাংসের একটি পাখির কোষ থেকেই দ্রবণের কোষগুলোকে পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি করা হয়েছে কিন্তু নাগেটরূপে প্লেটে আসতে কোন পাখি হত্যা করা হয়নি! আর এই পুরো প্রক্রিয়াটিই হয়েছে সিঙ্গাপুরে, ল্যাবের ভেতরে।
প্রযুক্তির কল্যাণে একদিন প্রাণিহত্যা ছাড়াই মাংস খাওয়া যাবে সে চিন্তা নিতান্তই দার্শনিক খেয়ালের বশে কিছু নিরামিষাশীর মনে এলেও শেষ পর্যন্ত তা এবার সত্যি হতে চলেছে।
অনেক বছর ধরেই গবেষণাগারে এই 'কালচারড মিট' তৈরীর প্রচেষ্টা চলছিল। বাণিজ্যিকভাবে অনুমোদনের ঘোষণা দেয়ার পর এটির প্রথম বিক্রয় শুরু হলো সিঙ্গাপুরের হাত ধরে। এখন পর্যন্ত দেশটির ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি ক্লাবের কাছে এই মাংস সরবরাহ করা হচ্ছে যারা প্রতি প্লেট নাগেটস বিক্রি করছে ২৩ ডলারের বিনিময়ে। ল্যাবরেটরিতে উৎপন্ন মুরগির স্বাদ এখন পর্যন্ত গ্রহণ করেছেন ২০০ জন।
ইট জাস্ট ইনকর্পোরেশন নামক সানফ্রান্সিসকোর একটি ফুড-টেক সংস্থা এই মাংস সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে।
তবে উৎপাদন প্রক্রিয়াটিকে পুরোপুরি প্রাণী নিধনহীন বলা যাচ্ছে না।
পুষ্টিকর দ্রবণের যেসব উপাদান এই ইট জাস্ট কোম্পানির মুরগির কোষের লালনে ব্যবহৃত হয়, তার একটি হলো বোভাইন সিরাম; এটি জবাইকৃত গবাদি পশু থেকে সংগ্রহ করতে হয়। তবে সংস্থাটি জানিয়েছে যে তারা, একটি প্রাণী-মুক্ত বিকল্প উপাদান ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে; এটি নিয়ে সিঙ্গাপুরের নিয়ন্ত্রকদের সম্মতির অপেক্ষায় আছে তারা।
বিভিন্ন দেশের আরও এক ডজন সংস্থা এই কালচারড মিটের বিকাশে কাজ করে যাচ্ছে। শুধুই কি মুরগি , তারা বিশেষ ধরনের গরুর মাংস থেকে শুরু করে স্যামন এমনকি পরীক্ষাগারে ক্যাঙ্গারুর মাংস তৈরির চেষ্টা করছে বলেও শোনা যায়।
গবেষণা সংস্থাগুলোর দাবি, এসব কালচারড মিটের অনেক সুবিধা রয়েছে। সীমিত জায়গা ব্যবহার করে ঘরের ভেতরেই এর বিকাশ সাধন করা যায়। ইট জাস্টের উৎপাদনে তো কোন এন্টিবায়োটিকও লাগেনি।
১৯৭৫ সালে প্রকাশিত "অ্যানিম্যাল লিবারেশন" বইটির লেখক এবং প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির দর্শনের অধ্যাপক পিটার সিঙ্গার রয়েছেন এই কালচারড মিট নিয়ে আগ্রহীদের তালিকায়। ৫০ বছর যাবত নিরামিষাশী থাকার পরেও এই মাংসের বাণিজ্যিকভাবে বিপণন শুরু হলে তিনি চেখে দেখবেন বলে জানিয়েছেন।
প্রাণীজগতের প্রতি মানুষের অবজ্ঞা, অসম্মানকে ফুটিয়ে তোলার জন্য পিটারই প্রথম তার বইতে প্রজাতিবাদ (স্পেসিসিজম) শব্দের প্রবর্তন করেছিলেন।
তবে মুদ্রার ওপর পিঠও আছে। অনেক ভেজিটেরিয়ান উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এই ধরনের চর্চার ফলে মানুষের মনে এই ধারণা আরও শক্তপোক্ত হয়ে উঠবে যে, মানুষের আসলে প্রাণিজ মাংস ছাড়া চলে না।
ইট জাস্টের চিফ এক্সিকিউটিভ জোশ টেট্রিক অবশ্য এতকিছু ভাবছেন না। তার বিশ্বাস, সামনের দিনগুলোতে ভেগান এবং ভেজিটেরিয়ান উভয় এই কোষ-উত্থিত মাংসের জন্য নতুন নতুন প্রত্যয় আবিষ্কার করবেন। তিনি নিজে এখন পর্যন্ত এই মাংসের জন্য যুতসই কোন নাম খুঁজে পাননি।
নিজেও গত ১৫ বছর যাবত ভেগান জীবনাচরণ অনুসরণ করে আসা টেট্রিক বলেন, " আমি ভেগান তবে আমি শুধু আমাদের উৎপাদিত মুরগি খাই!" শুনতে অদ্ভুত হলেও তার বিশ্বাস কিছুদিনের মধ্যেই মানুষের মাঝে এই বিষয়টি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
- সূত্রঃ দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল