আর্থিক প্রণোদনা পেতে রপ্তানিতে জালিয়াতি
রপ্তানি খাতকে উৎসাহিত করতে সরকার প্রণোদনা দিচ্ছে। আর সেই আর্থিক প্রণোদনা হাতিয়ে নিতে বিদেশে পণ্য রপ্তানি না করেই রপ্তানি দেখিয়ে প্রণোদনা নেওয়ার ঘটনা বাড়ছে। রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণের আগে স্ক্যানিং না হওয়া এবং কায়িক পরীক্ষা কম হওয়ার সুযোগে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অতিরিক্ত পণ্যের কাগজ দেখিয়ে প্রণোদনা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে রপ্তানিকারকদের বিরুদ্ধে।
১৫ দিনের ব্যবধানে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানির সময় সবজি ও খাদ্য সামগ্রীর দুটি চালানে এমন জালিয়াতির প্রমান পেয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষ। এর সাথে বিদেশে মুদ্রা পাচার, কালো টাকা সাদা করার অপচেষ্টা আছে বলে ধারণা করছে চট্টগ্রাম কাস্টমস।
এসব ঘটনায় রপ্তানিকারক, সিএন্ডএফ এজেন্ট এবং বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোর (অফডক) কর্মচারী জড়িত বলে মনে করছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ও অফডক।
সিলেটের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইউনিপেক্স ট্রেড কর্পোরেশন লিমিটেড আমেরিকার নিউইয়র্কের ফাতিমা ব্রাদার্স ইনক এর কাছে ২৪,০৩২ ইউএস ডলার মুল্যের ৮,০৯৮ কেজি ফ্রোজেন ভেজিটেবল রপ্তানি করছিলো। সাধারণত রপ্তানি পণ্য কায়িক পরীক্ষা করা না হলেও গোপন তথ্যের ভিত্তিতে গত ৭ জানুয়ারি চালানটির শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। সেখানে ৮,০৯৮ কেজির স্থলে পাওয়া যায় ৪,৩২০ কেজি ফ্রাজেন ভেজিটেবল। এই চালানে ঘোষণা বহির্ভূত মিষ্টি এবং গুড় পাওয়া যায় ৩,৪৩৮ কেজি। এই চালানে ২০% হারে প্রায় ৪৮০৬ ডলার বা ৮৫ টাকা হারে ৪ লাখ ৮ হাজার ৫৪৪ টাকা প্রণোদনা নিতো এই কোম্পানিটি।
রপ্তানি খাতকে উৎসাহিত করতে সরকার বিভিন্ন রপ্তানি পণ্যে ৩৭ টি খাতে নগদ প্রণোদনা প্রদান করছে। এর মধ্যে কৃষিপণ্যের আওতায় শাকসবজি ও ফলমূল রপ্তানিতে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ প্রণোদনা রয়েছে।
১৮ ডিসেম্বর ২০২০ ঢাকার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বাংলা ফুড এন্ড বেভারেজ লি ২২ টন খাদ্য সামগ্রী রপ্তানির ঘোষণা দিয়ে মাত্র ৫০০ কেজি (আধা টন) খাদ্য সামগ্রীর প্রমান পায়। ইস্টার্ন লজিষ্টিক নামক একটি বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো থেকে পণ্যটি রপ্তানি হচ্ছিল। ইস্টার্ন লজিষ্টিক এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কাস্টমস এর জেনারেল বন্ড শাখাকে নির্দেশনা দিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস।
এই ঘটনার পর বাংলা ফুড এন্ড বেভারেজ লি: এর ইতোমধ্যে রপ্তানি হওয়া ২২ কোটি ৯৪ লাখ টাকার ৫২ টি রপ্তানির চালান খতিয়ে দেখছে কাস্টমস। এসব চালানে কি পরিমান রপ্তানি প্রনোদনা আত্মসাৎ করা হয়েছে এবং কোন মুদ্রা পাচারের ঘটনা ঘটেছে কিনা তা জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিভাগে চিঠি দিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
দেশের ১৯ টি বেসরকারি আইসিডি থেকে প্রায় শতভাগ রপ্তানি পণ্য সরাসরি বন্দরে জাহাজীকরণের জন্য চলে আসে। তাই এসব ঘটনায় আইসিডির সংশ্লিষ্টতা আছে বলে মনে করছে কাস্টম। তাই আগামী ১৩ জানুয়ারি বেসরকারী আইসিডি মালিক সংগঠন বিকডা নেতৃবৃন্দকে বৈঠকে ডেকেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস ।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অডিট ইনভেস্টিগেশন এন্ড রিসার্স (এআইআর) ইউনিটের সহকারী কমিশনার রেজাউল করিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পরপর দুটি ঘটনার প্রেক্ষিতে আমরা মনে করছি রপ্তানির আড়ালে অবৈধভাবে সরকারি প্রণোদনা গ্রহণ, কালো টাকা সাদা করা, মানি লন্ডারিং অপচেষ্টা করছে একটি সংঘবদ্ধ চোরাচালান চক্র। তারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি খাতকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা করেছে। এ বিষয়ে আমরা আইসিডি গুলোতে নজরদারি বাড়িয়েছি। এ লক্ষে বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোটস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকড়া) সাথে ১৩ জানুয়ারি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
ইস্টার্ন লজিষ্টিক এর চেয়ারম্যান শাহ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, একটি চক্র রপ্তানি প্রনোদনা আত্মসাৎ করতে বেসরকারী আইসিডিগুলোর কিছু অসৎ কর্মকর্তাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। জালিয়াতির এই ঘটনার সাথে জড়িত থাকার দায়ে আমার প্রতিষ্ঠানের এ্যসিসটেন্স ম্যানেজার (এক্সপোর্ট) নয়ন মিয়া এবং সুপারভাইজার সুজনকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। রপ্তানিকারক, সিএন্ডএফ এজেন্ট এর মালিক এই চক্রের অন্যতম হোতা বলে আমি মনে করি।
রপ্তানিকারক বাংলা ফুড এন্ড বেভারেজ লি: এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম জাহাঙ্গীর হোসাইন বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুন্ন এবং হয়রানির উদ্দেশ্যে একটি চক্র এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে। জালিয়াতি কিংবা প্রণোদনার অর্থ আত্মসাৎের কোন সংশ্লিষ্টতা আমাদের নেই।
সিএন্ডএফ এজেন্ট আর ইসলাম এজেন্সির প্রোপাইটর মো: রফিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, রপ্তানিকারকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আমরা কাস্টম হাউসে বিল অব এক্সপোর্ট দাখিল করেছি। সিএন্ডএফ এজেন্ট হিসেবে এতে আমাদের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।
ইউনিপেক্স ট্রেড কর্পোরেশন লি: এর জেনারেল ম্যানেজার ইশতিয়াক আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আমরা পাটালি গুড়, মরিচা গুড এবং মিষ্টি একই এইচএস কোডে ফ্রোজেন ভেজিটেবল হিসেবে উল্লেখ করেছি। এতে আর্থিক প্রনোদনা আত্মসাৎ এবং মানি লন্ডারিং এর কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।
বিকডা'র সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল আমিন শিকদার বলেন, রপ্তানি পণ্যের কার্টনে কী পণ্য আছে ডিপো কর্তৃপক্ষের দেখার অধিকার নেই। তবে ঘোষানার চেয়ে কম কার্টন থাকলে অবশ্যই ডিপো কর্তৃপক্ষের দায় রয়েছে। ডিপোর কিছু অসৎ কর্মকর্তার যোগসাজসে এসব ঘটনা ঘটছে। এসব বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে শীঘ্রই বিকডা আলোচনায় বসছে।