করোনার প্রভাবে কর্ম হারিয়ে অনেকেই ঢাকায় এসে চালাচ্ছেন রিকশা
দীর্ঘদিনের লকডাউন তুলে দেওয়ার পর কাজের সন্ধানে রাজধানীতে রিকশাচালকদের চাপ বেড়েছে। প্রতিদিনই ঢাকায় বাড়ছে নতুন রিকশাচালকের সংখ্যা। করোনায় কর্ম হারিয়ে ও মফস্বলের অনেক মানুষ ভাড়ায় রিকশা নিতে ভিড় করছেন রাজধানীর বিভিন্ন গ্যারেজে। রিকশার তুলনায় চালকের সংখ্যা বেশি হওয়ায় রিকশা না পেয়ে অনেকে হতাশ হচ্ছেন।
মহামারির আসার আগেও রাজধানীর গ্যারেজগুলোতে ভাড়ায় রিকশা চালানোর এত চাহিদা ছিল না বলে অভিমত চালক ও গ্যারেজ মালিকদের।
রাজধানীর বেড়িবাঁধ শনিরবিল এলাকার একটি গ্যারেজের রিকশা ভাড়ায় চালান চাপাইনবাবগঞ্জের আবিদুর রহমান। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের গ্যারেজের ৮০ জন রিকশাচালকের মধ্যে ২১ জনই নতুন করে ঢাকায় রিকশা চালাচ্ছেন। এই ২১ জনের সবাই করোনার আগে চাপাইনবাবগঞ্জে অন্য পেশায় ছিলেন। এখন বাধ্য হয়ে ঢাকায় রিকশা চালাচ্ছেন তারা।'
সোলাইমান হোসেন (৪২) নরসিংদীর একটি কাপড় দোকানে সেলসম্যান হিসেবে ৮ বছর কাজ করেছেন। করোনাভাইরাস আসার পর বেচা-বিক্রি না থাকায় চাকরি চলে যায় তার। গ্রামে দীর্ঘদিন বেকার থাকার পর লকডাউন উঠে গেলে ১৫ আগস্ট ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন।
টিবিএসকে তিনি বলেন, 'আমি শেষবার রিকশা চালিয়েছিলাম ১৫ বছর আগে। করোনায় কাপড়ের দোকানের চাকরি হারিয়ে পাচঁ সন্তানের পরিবার নিয়ে চোখে-মুখে কোনো পথ না দেখে বাধ্য হয়ে আবার রিকশা চালানো শুরু করেছি। কিন্তু বর্তমানে ঢাকায় চালকের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সপ্তাহের প্রতিদিন রিকশা পাই না; এক-দুই দিন বসে থাকতে হয়।'
রবিউল আলম (৩৬) কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জের একটি চালের আড়তে। করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হলে চাকরি চলে যাওয়ায় দীর্ঘ দেড় বছর গ্রামের বাড়ি বরিশালে ধার-দেনা করে সংসার চালিছেন। গত ঈদের আগে দিন নিরুপায় হয়ে ঢাকায় এসেছেন কাজের সন্ধানে।
রবিউল আলম বলেন, 'ঢাকায় এসেছিলাম যেকোনো একটি কাজ জোগার করতে; কিছু না পেয়ে বাধ্য হয়ে এখন রিকশা চালাচ্ছি।'
তিনি আরও বলেন, 'লকডাউনে প্রতিদিনই ভাড়ায় রিকশা চালাতে পেরেছি, কিন্তু এখন লকডাউনের পর গ্রামে চলে যাওয়া চালকরা ও নতুন নতুন চালক ঢাকায় আসায় গ্যারেজে ঠিক মতো রিকশা পাই না। আজ আমি রিকশা পাইনি। সারাদিন বসে আছি, যদি বিকালে বা সন্ধায় কোনো রিকশা পাই, তা নিয়ে বের হব।'
শুধু রবিউল ও সোলাইমানই নন, রাজধানীর প্রায় ৩০-৪০ জন রিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলে প্রায় একই চিত্র পাওয়া যায়।
তেজগাঁও বিবিকা মোড়ের একটি রিকশা গ্যারেজের ম্যানেজার সোহেল আহমেদ (৫০) টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের গ্যারেজে মোট ৬০টি রিকশা রয়েছে। লকডাউনের সময় ২৫-৩০টি রিকশা পড়েই ছিল। এখন সবগুলো রিকশা এই চলে। আজকেও প্রায় ১০-১৫ জন রিকশাচালক রিকশা না থাকায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।'
মগবাজারের মধুবাগের রোবেল খান গ্যারেজের ম্যানেজার মানিক হোসেন বলেন, 'এখনো প্রায় ৪০-৫০ জন পরিচিত রিকশাচালক ঢাকায় ফিরেননি। অথচ ইতোমধ্যে সব রিকশা ভাড়া হওয়ায় অনেক চালককে রিকশা দিতে পারছি না। আমাদের গ্যারেজের ১৮০টি রিকশার মধ্যে আজকে সবগুলোই রাস্তায়। সকাল-বিকেল কোনো শিফটেই রিকশা খালি থাকছে না। অথচ স্বাভাবিক সময়ে ১০০-১২০টিও ভাড়া হতো না। লকডাউনেও ৫০-৬০টি রিকশা ভাড়া হয়নি।'
আম বাগান, মধুবাগ, কাঁঠাল বাগান, চানখারপুল, কামরাঙ্গীরচর, বেড়িবাঁধ, মিরপুর, তেজগাঁও, দক্ষিণখান প্রভৃতি এলাকার বিভিন্ন গ্যারেজ ঘুরে এই চিত্র পাওয়া যায়।
একদিকে, অনেক রিকশাচালকই ঢাকায় প্রথম এসেছেন, যারা আগে গ্রামে অন্য পেশায় ছিলেন বা ঢাকার বাইরে রিকশা চালাতেন বলে জানিয়েছেন গ্যারেজ মালিকরা।
মগবাজার আমবাগানের গ্যারেজ মালিক লুৎফর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'প্রতিদিন প্রায় ১৫-২০ জন গ্রামের রিকশাচালক রিকশা নিয়ে যাচ্ছেন। করোনায় জেলা শহর বা গ্রামে রিকশার আয় কমে যাওয়ায় তারা ঢাকায় এসেছেন বেশি আয়ের আশায়। এছাড়া অন্য পেশা থেকে প্রায় শতকরা ১০ জন মানুষ করোনায় নিরূপায় হয়ে এখন নতুন করে রিকশা চালাচ্ছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'রিকশার তুলনায় চালকের সংখ্যা বেশি হওয়ায় আমরা পুরাতন চালক এবং গ্রামেও আগে রিকশা চালিয়েছেন, এমন চালকদের রিকশা ভাড়া দিতে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছি। তারপর বাকি থাকলে নতুন করে এ পেশায় আসা লোকদের রিকশা দিচ্ছি।'
এদিকে রাস্তায় রিকশা বেশি থাকায় তুলনামূলক আয় কমেছে চালকদের। যাত্রী না থাকায় বসে থাকতে হচ্ছে বেশির ভাগ সময়।
মিরপুরের রিকশাচালক জালাল উদ্দিন বলেন, 'করোনায় কাজ না থাকায় অনেকেই এখন নতুন করে রিকশা চালান। তাই রাস্তায় আগের তুলনায় রিকশা বেশি। আর, করোনায় মানুষের হাতে আগের মতো টাকা না থাকায় রিকশায়ও একটু কম ওঠেন। সব মিলিয়ে আয় কমে গেছে রিকশাচালকদের।'
'আগামী ডিসেম্বরে ধান কাটার মৌসুম না আসা পর্যন্ত বাজার এমন মন্দাই থাকবে। ধান কাটার সময় এলে কিছু চালক গ্রামে ধান কাটতে চলে গেলে বাকিদের যাত্রী সংখ্যা বাড়বে,' যোগ করেন তিনি।
দেশের ৬৪ জেলায় ২ হাজার ৬৭৫ জন নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে পরিচালিত বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের চালানো এক জরিপে দেখা যায়, চরম দারিদ্র্যের হার আগের তুলনায় বেড়ে গেছে ৬০ শতাংশ। ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে কোনো খাবার নেই। তাদের মধ্যে রিকশাচালকেরও একটি বড় সংখ্যা রয়েছে।
এ বছরের ৩১ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিলের মধ্যে জরিপটি পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের 'অর্গানাইজিং দ্য ইনফরমাল ইকোনমি ওয়ার্কার্স: অ্যা স্টাডি ইন রিকশা পুলারস ইন ঢাকা সিটি' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা শহরে এখন আনুমানিক ১১ লাখ রিকশা রয়েছে। করোনায় আয় কমে যাওয়ায় এসব রিকশাচালকেরা অর্থকষ্টে রয়েছেন।