কোভিডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা দোকান বিক্রি করে দিচ্ছেন, কিনছেন সঞ্চয়ীরা
গুলশান-২ এলাকার পিংক সিটি শপিং মলে স্বর্ণ-ব্যবসা করতেন আসলাম হোসেন হিরু। মলের চারতলায় ছিল তার দোকান— অহনা জুয়েলারি। কোভিড-১৯-এর প্রভাবে ব্যবসায় মন্দা দেখা দেওয়ায় গত জুনে দোকানটি বিক্রি করে দেন তিনি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে হিরু বলেন, 'আমদানি করা রেডিমেড গহনা বিক্রির জন্য বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ও রাজধানীতে অহনা জুয়েলারির ৮টি শাখা আছে। ২০১০ সালে পিংকি সিটির ৯০০ বর্গফুটের এই দোকানটা কিনেছিলাম দেড় কোটি টাকায়। ব্যবসা ভালোই হচ্ছিল। কিন্তু, গত বছর করোনা সংক্রমণ শুরু হলে ব্যবসায় মন্দা শুরু হয়।
'গত বছর ও এই বছর বেশিরভাগ সময়ই দোকান বন্ধ রাখতে হয়েছে। কিন্তু ব্যাংক ঋণের কিস্তি, প্রায় ৮টি শোরুমের প্রায় ৪০ জন কর্মচারীর বেতন ও দোকানের ইউটিলিটি বিল দেয়া বন্ধ হয়নি। এক পর্যায়ে হিমশিম খাচ্ছিলাম। ফলে এই দোকানটি বিক্রি করতে বাধ্য হই। এছাড়াও এই টাকা দিয়ে এখন অন্য শোরুমগুলো ভালোভাবে চালানোর চেষ্টা করছি।'
তিনি বলেন, '২০১০ সালে যে দামে দোকানটা কিনেছিলাম, হিসাবমতে এখন তার দ্বিগুণ দামে বিক্রি করার কথা। কিন্তু করোনার মধ্যে সেভাবে ক্রেতা না পাওয়ায় মাত্র ১ কোটি ৮০ লাখ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি।'
আসলাম হোসেন হিরু জানান, গত দেড় বছরে এই শপিংমলে আরও ৮টি কমার্শিয়াল স্পেস বা দোকান বিক্রি হয়েছে।
শুধু পিংক সিটি শপিং মল নয়, করোনার প্রকোপে রাজধানীসহ সারা দেশেই বিভিন্ন শহরে অনেক ব্যবসায়ীর এরকম কমার্শিয়াল স্পেস, কমার্শিয়াল ভবন ও কমার্শিয়াল ল্যান্ড/ জমি বিক্রি বেড়েছে।
অনেক দোকান মালিক ব্যবসা শুরুর আগেই তাদের জায়গা বিক্রি করছেন, কারণ তারা মহামারির কারণে তারা তাদের ব্যবসায়িক সম্ভাবনা সম্পর্কে অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পড়েছেন, বলে জানান রাজধানীর মৌচাকের ফরচুন শপিং মলের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি গাউসুল আজম চঞ্চল।
এফবিসিসিআই-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আমিনুল হোক শামীম টিবিএসকে বলেন, "করোনার প্রভাবে ব্যবসায়ীরাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো সহায়তা না থাকায় তারা ক্ষতি সামলে উঠতে পারছেন না। তাই অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে বিকল্প উপায়ে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ব্যবসা বন্ধ করে, ব্যবসার জায়গা বিক্রি করে দিচ্ছেন তারা।"
এদিকে বাণিজ্যিক এসব সম্পত্তি বিক্রি বাড়লেও, সে তুলনায় ক্রেতার সংখ্যা কম। তাই বিক্রির সময় প্রত্যাশিত দামও মিলছে না।
স্বর্ণ-ব্যবসায়ী হিরুর দোকানটি কিনেছেন গুলশানের বাসিন্দা সুইজারল্যান্ড প্রবাসী মামুনুল ইসলাম নাহিদ। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'তুলনামূলক কম দামে পাওয়ায় দোকানটা কিনে রাখলাম। ছোট ভাইকে দিয়ে কাপড়ের দোকান চালু করব।'
ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রি অফিস ও ঢাকার বিভিন্ন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের তথ্যানুসারে, এ বছরের প্রথম ছয় মাসে কমার্শিয়াল স্পেস, ভবন ও জমি ক্রয়-বিক্রয়ের পরিমাণ গত বছরে হওয়া ৮২ শতাংশকে ছাড়িয়ে গেছে।
আনুষ্ঠানিক তথ্যানুসারে, এ বছরের জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত শুধু ঢাকা জেলা ও মহানগরীতে ১ লাখ ১৬ হাজার কমার্শিয়াল স্পেস, ভবন ও জমি ক্রয়-বিক্রয়ের দলিল নিবন্ধন হয়েছে সাবরেজিস্ট্রি অফিসগুলোয়। যার মূল্য প্রায় ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। নিবন্ধন থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা।
২০২০ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ৬৮ হাজার ৪০০ কমার্শিয়াল স্পেস, কমার্শিয়াল ভবন ও কমার্শিয়াল ল্যান্ড ক্রয়-বিক্রয়ের দলিল নিবন্ধন হয়েছিল। যার মূল্য প্রায় ৫ হাজার ২১০ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায় ছিল প্রায় ৩৮০ কোটি টাকা।
নিবন্ধন অধিদপ্তরের সূত্রগুলি জানায়, সারা দেশে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে এসব বিক্রয়ের নিবন্ধন থেকে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। ২০২০ সালের সম্পূর্ণ মেয়াদে হওয়া রাজস্বের চেয়ে যা মাত্র ১২শ কোটি টাকা কম।
মৌচাকের ফরচুন শপিং মলে এরকম ৩টি দোকান বিক্রয়ের নোটিশ এখনো রয়েছে বলে জানান শপিং মলটির দোকান মালিক সমিতির সভাপতি গাউসুল আজম চঞ্চল। তিনি জানান, গত দেড় বছরে প্রায় ১৭টি দোকান বিক্রি হয়ে গেছে। অনেকে কেনার পর এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবসা শুরু করতে পারেননি।
মৌচাকের ফরচুন শপিং মলের রেডিমেড কাপড় ব্যবসায়ী সাদ্দাম হোসেন গত বছরের অক্টোবরে তার 'ছামিয়া ফ্যাশন' নামের দোকনটি বিক্রি করে দিয়ে ১১ লাখ টাকায় একটি প্রাইভেট কার কিনে ভাড়ায় চালাচ্ছেন বলে জানান।
রাজধানীর বসুন্ধরা শপিং মলে সরেজমিনে দেখা যায়, মলের দ্বিতীয় তলায় সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের পাশের চারটি দোকান বিক্রির জন্য নোটিশ ঝোলানো আছে। এছাড়াও ৬ষ্ঠ তলায় ফুড কোর্টে তিনটি দোকান ভাড়া দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া আছে।
বসুন্ধরা শপিং মলের একজন বিপণন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, এরকম প্রায় ১১টি দোকান বিক্রয়ের নোটিশ দিয়েছেন দোকান মালিকরা। তারা এই দোকানগুলো এককালীন কিনেছিলেন।
ঢাকার জেলা রেজিস্ট্রার সাবেকুন নাহার জানান, ঢাকার অন্যান্য এলাকার তুলনায় গুলশান, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, পল্টন, মতিঝিল, ধানমন্ডি ও উত্তরা এলাকায় কমার্শিয়াল স্পেস, ভবন ও জমি বিক্রি বেশি হয়েছে। কারণ এসব এলাকায় শপিংমল ও কমার্শিয়াল ভবনও বেশি।
মধ্যস্থতাকারীদের রমরমা:
প্লট, ফ্ল্যাট, বাড়ি, কমার্শিয়াল স্পেস, কমার্শিয়াল ভবনের মধ্যস্থতাকারীদের (দালাল হিসেবে পরিচিত) ব্যবসা বেশ জমেছে। কয়েকজন মধ্যস্থতাকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনার কারণে যেসব কমার্শিয়াল স্পেস, ভবন বা জমি বিক্রি হচ্ছে, তার বেশিরভাগই তাদের মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে। বেশিরভাগ সময় তারা একটি নির্দিষ্ট দাম নির্ধারণ করে বিক্রেতার সঙ্গে চুক্তি করেন। বিক্রির সময় তার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করে অতিরিক্ত টাকা তারা নিয়ে নেন। অনেক সময় আবার কমিশন নেন।
গুলশান ও তেজগাঁও এলাকার প্রতিষ্ঠিত মধ্যস্থতাকারী নাজিম আহমেদ টিবিএসকে জানা, গত দেড় তিনি একাই এরকম প্রায় ৪০টি স্পেস বিক্রির মধ্যস্থতা করেছেন। এখন ১১টি কমার্শিযাল স্পেস তার হতে আছে। এই ফাঁকে সস্তায় পেয়ে প্রায় সাড়ে ৮০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ব্যক্তিগতভাবে গুলশান ও তেজগাঁও এলাকায় ৫টি দোকান কিনে রেখেছেন তিনি।
নজিম উদ্দিন বলেন, 'টাকা বিনিয়োগ করে রেখেছি, করোনা পার হলেই দ্বিগুণ দামে এগুলো বিক্রি করে দেব।'