খনি থেকে উত্তোলন করার মতো স্বর্ণ বিশ্বে আর কতটুকু অবশিষ্ট আছে?
গত মাস বা আগস্টে রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছিল স্বর্ণের দর, যা আউন্স প্রতি ২,০০০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয়কারী ব্যবসায়ীদের কারণেই এমন দরপ্রবৃদ্ধি। নেপথ্যে আবার ভূমিকা রেখেছে মহামারির কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে অনিশ্চয়তা।
তবে, বাজার চাহিদা বৃদ্ধির সুবাদে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে এ দর প্রবৃদ্ধি। প্রশ্ন জাগছে; দূর্মুল্য ধাতুটির সরবরাহ নিয়ে এবং কবে নাগাদ তার প্রাকৃতিক যোগান শেষ হয়ে যেতে পারে- এমন কিছু বিষয়ে।
স্বর্ণের সবচেয়ে বড় চাহিদা বিনিয়োগ উৎস হিসেবে। এটি আভিজাত্যেরও প্রতীক। এর বাইরে অসংখ্য ইলেকট্রনিক পণ্যের কিছু মূল যন্ত্রাংশ তৈরিতে ব্যবহার হয় স্বর্ণের প্রলেপ।
কিন্তু, এটি একটি সীমিত সম্পদ এবং এমন একটা সময় অবশ্যই আসবে- যখন খনি থেকে উত্তোলন করার মতো কোনো স্বর্ণ আর পাওয়া যাবে না।
সবচেয়ে বেশি উত্তোলনের বছর:
বিশেষজ্ঞরা 'স্বর্ণ চূড়া' নামক এক ধারণার ব্যাপারে বলেন। যার মাধ্যমে এক বছরে উত্তোলন করা সম্ভব এমন সমস্ত স্বর্ণ আকরিক বছর শেষের আগেই উত্তোলন করা হয়ে গেছে, এমন অবস্থা বোঝায়। বর্তমানে অনেক বিশেষজ্ঞ ধারণা করছেন, আমরা সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেছি।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের (ডব্লিউজিসি) মতে, ২০১৯ সালে খনি থেকে ধাতুটির উত্তোলন ও পরিশোধন মোট ৩,৯৫১টন হয়েছিল। যা ছিল ২০১৮ সালের চাইতে আবার ১% কম। ২০০৮ সালের পর ওই প্রথমবারের মতো চাহিদা থাকা সত্বেও স্বর্ণখনি থেকে বাৎসরিক উৎপাদনের ঘাটতি দেখা যায়।
ডব্লিউজিসি মুখপাত্র হান্নাহ ব্রান্ডস্টাট্টের বলেন, ''আগামী বছরগুলোতে বর্তমানে সচল থাকা খনি থেকে সরবরাহ ধীরগতির হতে পারে বা কমেও যেতে পারে। কারণ, প্রতিনিয়ত উত্তোলনের ফলে খনিতে বিদ্যমান আকরিকের মজুদ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, নতুন স্বর্ণখনির সন্ধান পাওয়াটাও হয়ে পড়েছে অনেক কঠিন। এ অবস্থায় স্বর্ণ উৎপাদনের শীর্ষ অবস্থায় বিশ্ববাজার অবস্থান করছে-এমন মন্তব্য আগেভাগে করাটা ঠিক হবে না।''
'স্বর্ণ চূড়া' প্রবণতা যখন দেখা যায়- বিশেষজ্ঞরা জানান তারপরের কয়েক বছর উৎপাদনে নাটকীয় পতন নাও দেখা যেতে পারে। কিন্তু, তার পরের দশকগুলোয় ধীরে ধরে স্বর্ণখনির মজুদ নিঃশেষ হওয়াটাই আমরা লক্ষ্য করতে পারি।
''খনি থেকে উৎপাদন এখন সমান্তরাল পর্যায়ে আছে। এবং ধীরে ধীরে তা আগের চাইতে পতনের পর্যায়ে অবস্থান করছে। অবশ্য, তা খুব নাটকীয় ব্যাপার নয়'' বলছিলেন মেটালসডেইলি ডটকমের বিশেষজ্ঞ রস নরম্যান।
কতটুকু স্বর্ণ অবশিষ্ট আছে?
ভুগর্ভে কতটুকু স্বর্ণ মজুদ আছে তা খনি কোম্পানিগুলো দুইভাবে নির্ণয় করে;
মজুদ: আকরিকের কতটুকু উত্তোলন চলতি বাজারদর অনুসারে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক।
উৎস: আরও অনুসন্ধানের মাধ্যমে যে স্বর্ণ আকরিক খনিতে পাওয়া যাবে এবং যা উচ্চবাজারমূল্য অনুসারে এক সময় উত্তোলনের মাধ্যমে মুনাফা করা যাবে।
স্বর্ণ মজুদের প্রথমোক্ত প্রক্রিয়াতে উৎস পদ্ধতির চাইতে বেশি সঠিক উপাত্ত পাওয়া যায়। তবে এটি বেশ জটিল এক প্রক্রিয়া।
মার্কিন ভূতত্ত্ব জরিপ বিভাগ সূত্র জানাচ্ছে, বর্তমানে মাটির নিচে ৫০ হাজার টন স্বর্ণ মজুদ রয়েছে। সেই তুলনায় মানুষ খনির মাধ্যমে উত্তোলন করেছে প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার টন। এই হিসাব কিছুটা এদিক-সেদিক হতে পারে। তবে এর ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, এখনও বিশ্বের ২০ শতাংশ মজুদ খনির মাধ্যমে উত্তোলনযোগ্য। অবশ্য ভুলে গেলে চলবে না, প্রতিনিয়ত এ মজুদের পরিমাণও কমছে।
এক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি বর্তমানে আর্থিকমূল্য কম, এমন কিছু মজুদকে কম খরচে আহরণ করার পথ দেখাতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের অবিশ্বাস্য গতি থেকে খনি শিল্পও বিপুল লাভবান হয়েছে। বিশাল ভৌগলিক তথ্যভাণ্ডার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবটের ব্যবহার- আগামীদিনে খনি পরিচালনার খরচ অনেক কমাবে।
ভবিষ্যতে দুর্গম ও বিপজ্জনক ধাতবের অনুসন্ধানে রোবটই হয়ে উঠতে চলেছে সাধারণ কর্মকাণ্ডের অংশ; এমন কথাই জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
বড় উৎসসমূহ:
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ববৃহৎ একক স্বর্ণ উত্তোলন উৎস ছিল- দক্ষিণ আফ্রিকার উইটওয়াটারস্যান্ড নদীর খাড়ি। এপর্যন্ত উত্তোলিত স্বর্ণের ৩০ শতাংশ এখান থেকেই আহরণ করা হয়।
সোনালী ধাতবের অন্যান্য বড় উৎসের মধ্যে রয়েছে; দক্ষিণ আফ্রিকার গভীরতম খনি- এমপনেং, অস্ট্রেলিয়ার সুপার পিট এবং নিউমন্ট বডিংটন, ইন্দোনেশিয়ার গ্রাসবার্গ, এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা অঙ্গরাজ্যের কিছু খনি।
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বর্ণ উত্তোলক হচ্ছে চীন। এছাড়া, অন্যান্য বৃহৎ উৎপাদকেরা হলো; কানাডা, রাশিয়া এবং পেরু।
আর কোম্পানির হিসেবে ব্যারিক গোল্ড- এর মালিকানাধীন নেভাদা গোল্ড মাইনস হচ্ছে- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্বর্ণ খনি কমপ্লেক্স। বছরে এখান থেকে প্রায় ৩৫ লাখ আউন্স স্বর্ণ উৎপাদিত হয়।
এখনও কিছু খনি আবিষ্কার করা হচ্ছে, তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন বড় মজুদের সন্ধান পাওয়া দিন দিন আরও বিরল ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, সিংহভাগ স্বর্ণের যোগান আসছে দশকের পর দশক ধরে ব্যবহৃত পুরোনো খনি থেকেই।
কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়া:
বড় আকারের খনি পরিচালনায় বিপুল পুঁজি নিবেশের দরকার হয়, প্রয়োজন হয় দামি দামি সব যন্ত্রপাতির। তাছাড়া, বিশাল এলাকাজুড়ে খনি পরিচালনার ক্ষেত্রে পূর্ব অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই।
বর্তমানে পৃথিবীর ৬০% খনিজ কার্যক্রম ভুস্তরের উপরিভাগে করা হচ্ছে। বাকিগুলো সবই ভুগর্ভের অনেক নিচে অবস্থিত।
''স্বর্ণখনি পরিচালনা করা অনেক কঠিন হয়ে উঠেছে। কারণ, বড় আকারের এবং কম খরচে আকরিক উত্তোলন করা যেত এমন খনি; বিশেষ করে যেগুলো দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থিত- সেগুলোর আকরিক মজুদ প্রায় ফুরিয়ে আসছে'' জানান নরম্যান।
'সেই তুলনায় চীনের নতুন খনিগুলো আকারে ছোট এবং সেখানে উত্তোলনের ব্যয়ও অনেক বেশি' তিনি যোগ করেন।
পৃথিবীর স্থলভাগের অল্পকিছু স্থানেই এখন স্বর্ণখনি অনুসন্ধান করা বাকি আছে। বিশেষ করে, সংঘাতমুখর কিছু অঞ্চল যেমন পশ্চিম আফ্রিকায় স্বর্ণের মজুদ আবিষ্কারের সম্ভাবনা রয়েছে।