খামারের সঙ্গে বাড়ছে পোল্ট্রি ও পশুখাদ্যের বাজার
স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এখন প্রতিবেশি দেশগুলোতে রপ্তানির পথ খুঁজে নিয়েছে দেশের পশুখাদ্য উৎপাদন শিল্প। একসময়ের আমদানি নির্ভর এই শিল্পখাত এখন স্থানীয় বাজারের ৯৮ শতাংশ চাহিদা পূরণে সক্ষম।
বিগত এক দশকে পশুখাদ্য খাত প্রায় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। পোল্ট্রিসহ দেশে মৎস্য এবং গবাদি পশুর খামার বৃদ্ধি পাওয়ায় খাতটি দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে।
দেশে রেস্টুরেন্ট বাণিজ্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায়, পোলট্রির চাহিদাও বেড়েছে। রেস্টুরেন্টের মেন্যুর বিশাল অংশ জুড়েই আছে মাংসের বিভিন্ন পদ। পোলট্রির চাহিদা বাড়তে থাকায় তাই বেড়েছে পোল্ট্রি খাবারের চাহিদাও।
দেশের পোল্ট্রি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ এখন প্রায় ৪.১৬ বিলিয়ন ডলার। আগামী দশকের মধ্যে বিনিয়োগের পরিমাণ দ্বিগুণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা বছরে গড়ে প্রায় ১৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দেশের দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যেও উল্লেখজনক অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেছে। বর্তমানে, ডেইরি খাতের বার্ষিক বাজার মূল্য প্রায় ৮ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। ২০২৯ সালের মধ্যে দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভের পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমান উৎপাদন এক কোটি টনের কাছাকাছি হলেও, উৎপাদন পরিমাণ দ্বিগুণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফআইএবি) সাধারণ সচিব মোহাম্মদ আহসানুজ্জামান জানান, "খামারগুলো এখন আমদানিকৃত পশুখাদ্যের উপর নির্ভরতা কমিয়েছে।"
শিল্প সংশ্লিষ্ট মালিকদের মতে, পশুখাদ্য খাতের প্রবৃদ্ধি পশুসম্পদ শিল্পের সম্প্রসারণের উপর নির্ভরশীল।
২০০৭ সালে অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণের ধাক্কা সামলিয়ে গত এক দশকে দ্রুত বিস্তার লাভ করে দেশের পোল্ট্রি খাত। বর্তমানে, খাতটি পশুখাদ্য শিল্পের মূল চালকে পরিণত হয়েছে।
পশুখাদ্য শিল্প মূলত পোলট্রি, গবাদি ও বাছুর এবং মৎস্য এই তিনটি বৃহৎ খাতে সরবরাহ করে থাকে। বিগত বছর গুলোতে সবগুলো খাতেই ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে।
বর্তমানে, বাংলাদেশে পশুখাদ্যের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৬৩ থেকে ৬৪ লাখ টন। ২০২০ সালে, উৎপাদন মাত্রা চাহিদাকেও ছাড়িয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
গতবছর, পশুখাদ্যের বাণিজ্যিক উৎপাদন ৬৫ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে পোল্ট্রি খাদ্য ছিল ৪৪ লাখ ৫০ হাজার টন। অন্যদিকে, মৎস্য খাদ্য ও গবাদি পশুর খাদ্য যথাক্রমে ১৫ লাখ ৯০ হাজার টন এবং ৫ লাখ ৩০ হাজার টন করে উৎপাদিত হয়।
গত সাত বছরে পশুখাদ্য শিল্পে একলাফে ১৬১ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। শুধুমাত্র পোল্ট্রি খাতেই আছে এই খাতের ৬২.৯ শতাংশ খাদ্য। অন্যদিকে, গবাদি ও মৎস্য খাতে ব্যবহৃত খাদ্যের পরিমাণ যথাক্রমে ১৮ ও ২৩ শতাংশ।
মহামারির কারণে চাহিদা কমে যাওয়ার আগ পর্যন্ত খাতটিতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১২ থেকে ১৫ শতাংশ ছিল।
করোনার অভিঘাত সামলে নিতে শুরু করলেও, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়ছে খামার সংশ্লিষ্ট পণ্যের দামও।
পশুখাদ্য শিল্পখাতের প্রতিনিধি আহসানুজ্জামান বলেন, "কোভিড-১৯ এর কারণে এই খাতকে বহু ঝড়-ঝাপটা সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু শিল্পটি এখন তাদের ক্ষতি সামলে নিয়েছে, সেইসাথে বিক্রিও বাড়ছে ।"
"শিল্পখাতটি মহামারির ধাক্কা সামলে নিয়েও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে ব্যর্থ হবে," বলেন তিনি।
পশুখাদ্য বাজার
আইডিএলসির প্রতিবেদন অনুসারে, সাতটি পশুখাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের দখলে আছে বাজার। নারিশ পোলট্রি ফিড, এসিআই, কাজী ফার্মস, প্রভিটা ফিড, আফতাব ফিড, নিউ হোপ ফিড ও আমান ফিড- এই সাতটি প্রতিষ্ঠান বাজারের ৭০ শতাংশ দখল করে রেখেছে।
ইউনাইটেড ফিড, সিটি পোল্ট্রি, সিপি বাংলাদেশ আরআরপি অ্যাগ্রো, কোয়ালিটি ফিডস, এআইটি ফিডস এবং এজি অ্যাগ্রো- এই প্রতিষ্ঠানগুলোও পশুখাদ্য বাজারের বিশ্বস্ত নাম।
পোল্ট্রি সংগঠনের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে রেজিস্ট্রিকৃত পশুখাদ্য উৎপাদনকারীর সংখ্যা ২৬১। এছাড়া ১৩৫ থেকে ১৪০ টি প্রতিষ্ঠান প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে তাদের লাইসেন্স নবায়ন করেছে। এছাড়া, রেজিস্ট্রিবিহীন আরও ২০০ টি প্রতিষ্ঠান খাদ্য উৎপাদনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
বিপিআইসিসির সভাপতি মশিউর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পোল্ট্রির সমৃদ্ধির উপর নির্ভর করে খাদ্য শিল্প সহযোগী খাত হিসেবে বেড়ে উঠেছে। কিন্তু রেজিস্ট্রিবিহীন প্রতিষ্ঠানগুলো নিম্নমানের খাদ্য তৈরি করছে। ফলে, প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মানহানি ঘটছে।"
তবে, বিনিয়োগ সংক্রান্ত কোনো তথ্য দেখাতে পারেনি তারা।
লাইটক্যাসেল নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে শিল্পটি প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আয় করে। কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, ভেজাল কাঁচামাল, মান নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি এবং ভ্যাকসিন আমদানিতে উচ্চ কর সহ বিভিন্ন সমস্যা তালিকাবদ্ধ করে প্রতিষ্ঠানটি।
পশুখাদ্য উৎপাদন শিল্পে এখন উচ্চ বিনিয়োগের প্রয়োজন। চাহিদা অনুযায়ী বাড়ছে না উৎপাদন। এছাড়া, প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ইকোনমি অব স্কেল অর্জনও এখন প্রাথমিক সমস্যা বলে উল্লেখ করা হয়।
হাতে তৈরি থেকে শুরু করে আধুনিকায়ন
শুরুর দিকে, পশুখাদ্য প্রস্তুত প্রক্রিয়া ছিল মূলত শ্রম-নির্ভর। খাদ্যগুলো হাতে তৈরি করা হত। তবে, ৯০ এর দশকে স্থানীয় উদ্যোগক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হলে ক্রমেই আধুনিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদন জনপ্রিয় হয়।
এফআইএবির তথ্যানুসারে বাংলাদেশি ফিড মিলগুলো উন্নতমানের মেশিনারি প্রযুক্তি দ্বারা সমৃদ্ধ। এসব প্রযুক্তির অধিকাংশই ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছু প্রযুক্তি চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে।
এফআইবি কর্তৃক রেজিস্ট্রিকৃত অধিকাংশ কারখানাই আধুনিক এবং যন্ত্রচালিত। পশুখাদ্য খাতকে সহায়তা করতে চলতি অর্থবছরের বাজেটে সয়া কেক এবং সয়া প্রোটিন আমদানিতে রেগুলেটরি এবং সাপ্লিমেন্টারি কর রহিত করা হয়েছে। পশুখাদ্য তৈরিতে সয়াবিন এবং ভূট্টা ব্যবহারের পরিমাণ ৮০ শতাংশেরও বেশি। চাহিদা বাড়ায় গত কয়েক বছরে স্থানীয়ভাবে সয়াবিন ও ভূট্টার উৎপাদনও বেড়েছে।
বর্তমানে, পোল্ট্রি এবং মৎস খাদ্যের আমদানি প্রায় নেই বললেই চলে। বাংলাদেশি প্রস্তুতকারকদের পাশাপাশি বিদেশি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও খাদ্য উৎপাদন ব্যবসায় সম্পৃক্ত আছে।
তবে পোল্ট্রি ও মৎস্য খাদ্যে নির্ভরতা না থাকলেও, খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদান যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা হচ্ছে।
রপ্তানি পদক্ষেপ
২০১৯-২০ অর্থবছরে নয়টি প্রতিষ্ঠান বিদেশে পশুখাদ্য রপ্তানির অনুমোদন লাভ করে। প্রতিষ্ঠানগুলো হল- প্যারাগন গ্রুপ, অ্যাজাটা ফিড মিলস, সিপি বাংলাদেশ, আফতাব, এজি অ্যাগ্রো, কোয়ালিটি ফিডস লিমিটেড, আলিয়া ফিডস, আরআরপি ফিডস এবং নারিশ গ্রুপ।
এদের মধ্যে আটটি প্রতিষ্ঠান ভারতের ত্রিপুরা ও আসাম এবং নেপালে প্রায় ১ হাজার ১৭২ টন পোল্ট্রি ও মৎস্য খাদ্য রপ্তানি করেছে।
তবে, করোনার কারণে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের রপ্তানিতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। এবছর আবার আটকে যাওয়া মালামালের হস্তান্তর শুরু হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
- সংবাদটি ইংরেজিতে পড়ুন: Feed thrives as poultry grows
- অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা