গভীর সঙ্কটে দেশের পেঁয়াজ চাষীরা
রাজশাহীর পুঠিয়ার বিহারীপাড়া গ্রামের কৃষক আজিজুল হক ১৫ কাঠা জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ রোপন করেছিলেন। চাষাবাদ করতে পেঁয়াজ লেগেছিলো সাড়ে তিন মণ। দুই মাস আগে চাষাবাদ করার সময় পেঁয়াজের দাম ছিলো আকাশচুম্বী।
সাড়ে তিন হাজার টাকা মণ হিসেবে পেঁয়াজের দাম পড়েছিলো ১২ হাজার টাকা। জমি প্রস্তুত করা, শ্রমিক খরচ, কীটনাশক, সার ও নিড়ানী দেওয়ায় খরচ পড়েছিলো আরো ১০ হাজার টাকা। অর্থাৎ আজিজুল হকের ১৫ কাঠা জমিতে পেঁয়াজ চাষে মোট খরচ হয়েছিলো ২২ হাজার টাকা। তার ধারণা, সবমিলিয়ে ১৫ কাঠা জমিতে উৎপাদন হবে ২৫ থেকে ৩০ মণ পেঁয়াজ। অথচ রাজশাহীর বানেশ্বর পাইকারি বাজারে এখন প্রতি মণ পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকা দরে।
আজিজুল হক জানান, "ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানির কারণে কৃষকরা ব্যাপক লোকসানে পড়েছে। এমনিতেই পেঁয়াজ বাজারে ওঠার সময় দাম কম থাকে। সেখানে আমদানির কারণে ইতোমধ্য মণ প্রতি দেশীয় পেঁয়াজের দাম বাজারে চারশো থেকে পাঁচশো টাকা কমে গেছে। এই দাম সামনের দিনগুলোতে আরও কমে যেতে পারে। পেঁয়াজ বাজারে ওঠার সময় আমদানি না করে যখন দেশের চাহিদা থাকে তখন যদি আমদানি করতো তাহলে ভোক্তারাও লাভবান হতো এবং কৃষকরাও উপকৃত হতো। এজন্য কৃষকদের সাথে সরকারের সমন্বয়টা খুবই দরকার। কৃষকরা যে ফসলই উৎপাদন করে তাতেই লোকসান। এভাবে কৃষকরা মরে শেষ হয়ে যাবে।"
রাজশাহীর দুর্গাপুরের কৃষক জনাব আলীও জানালেন একই আশঙ্কার কথা। তিনি এক বিঘা জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ চাষ করেছেন। তিনি জানান, ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানির কারণে পেঁয়াজের দাম কমে যাওয়ায় কৃষকরা অনেক লোকসানে পড়বে। দুই মাস আগে পেঁয়াজের দাম বেশি থাকায় এবছর জমিতে চাষের পেঁয়াজ কিনতে প্রচুর খরচ পড়েছে। সে তুলনায় বাজারে পিঁয়াজের দাম অনেক কম।
একই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন মুড়িকাটা পিঁয়াজ উৎপাদনে শীর্ষে থাকা পাবনা, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকরা।
তারা সবাই বলছেন, ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানির কারণে কৃষকরা লোকসানে পড়বে। ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানির কারণে পিঁয়াজের দাম অনেক কমে গেছে। এতে লাভ তো দূরের কথা, খরচ উঠাই কঠিন হয়ে পড়বে বলে জানান তারা।
পাবনার সদর থানার নতুন গোহাইলবাড়ী গ্রামের কৃষক সাজাহান আলী তোফা। এবছর তিনি ১০ বিঘা জমিতে পিঁয়াজ চাষাবাদ করেছেন। ইতোমধ্যে তিনি সাত বিঘা জমির পেঁয়াজ জমি থেকে তুলে বাজারে বিক্রি করেছেন। আরও বিঘা তিনেক জমির পেঁয়াজ তার মাঠে পড়ে রয়েছে।
সাজাহান আলী তোফা জানান, "এক মাস আগে থেকে পিঁয়াজ তুলে বাজারে বিক্রি করেছি। তখন দাম পেয়েছিলাম মণপ্রতি ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। গতবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এরকমই দাম ছিলো। ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানির ঘোষণার পর পেঁয়াজের দাম ১ হাজার টাকা মণে নেমে আসে। আরও বিঘা তিনেক জমির পেঁয়াজ মাঠে আছে, তার দাম কেমন পাবো এখনই তা বলা যাচ্ছে না। আমার মতো কৃষকদেরই খরচ তুলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যারা অল্প পরিসরে পেঁয়াজ চাষাবাদ করেছেন তাদের অবস্থা আরও খারাপ হবে।"
প্রতিবছর নভেম্বরের শুরুতে দেশে আগাম মুড়িকাটা পেঁয়াজ উঠতে শুরু করে। এ পেঁয়াজ ছোট পেঁয়াজ রোপণ করে উৎপাদিত হয়। এটি সংরক্ষণ করা যায় না। বীজ থেকে উৎপাদিত পেঁয়াজ বছরজুড়ে সংরক্ষণ করা যায়।
গতবছরের শেষের দিকে পেঁয়াজের দাম লাগামছাড়া হওয়ায় এবছর চাষীরা বেশি লাভের আশায় পেঁয়াজ উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, দেশে ৬৫ হাজার ৯৬২ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ হচ্ছে। গতবছর চাষাবাদ হয়েছিলো ৬২ হাজার হেক্টর জমিতে। গতবছর মুড়িকাটা ও চারা পেঁয়াজ মিলে উৎপাদিত হয়েছিলো মোট ২৫ লাখ ৬০ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ।
রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও পাবনায় প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে পিঁয়াজ চাষাবাদ করা হয়েছে। গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ১৪.৩৯ মেট্রিক টন হিসেবে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৮৭ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে রাজশাহীতে ৫ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমিতে এবং পাবনায় ৯ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের চাষাবাদ হচ্ছে। সারা দেশের মধ্যে রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর মুড়িকাটা পেঁয়াজ উৎপাদনে শীর্ষে।
ঢাকার খামারবাড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামসুর রহমান জানান, "যশোর অঞ্চলসহ রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরসহ ২১টি জেলায় মুড়িকাটা পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। অঞ্চলভিত্তিক একেক এলাকায় একেক পরিমাণ পিঁয়াজ উৎপাদিত হয়। আলাদাভাবে মুড়িকাটা পেঁয়াজের উৎপাদনের হিসাব না থাকলেও গতবছর সব পেঁয়াজ মিলে গড়ে হেক্টরপ্রতি ১০.৭৬ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিলো। সাধারণত চারা পেঁয়াজের চেয়ে মুড়িকাটা পিঁয়াজের উৎপাদন কম হয়। তবে আমরা হিসাব করে দেখেছি পেঁয়াজ উৎপাদন করতে গড়ে কেজিপ্রতি ১৫ টাকা থেকে ১৬ টাকা ব্যয় হয়। সে হিসেবে কৃষকদের গড়ে কেজিপ্রতি পাঁচ টাকা লাভ হচ্ছে।"
বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে ১৭ লাখ ৩৮ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে।
অন্যদিকে আমদানি হয়েছিলো ৯ লাখ ৩২ হাজার টন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে মতে, সে বছর দেশে ২৪ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা ছিলো, সংরক্ষণে ওজন কমে যাওয়া ও পচে যাওয়ার পেঁয়াজের সংখ্যা বাদ দিয়ে এ হিসাব করা হয়।
গত দুই বছরে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৯ লাখ মেট্রিক।
এদিকে কৃষকরা পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ২৫ টাকা দরে বিক্রি করলেও, রাজশাহীর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা দরে এবং ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা দরে।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার স্বরূপপুর গ্রামের কৃষক নাজিম উদ্দিন জানান, "এক বিঘা জমিতে সাত থেকে আট মণ পেঁয়াজের বীজ লাগে। ৪ হাজার ৪০০ টাকা মণ হিসেবে বীজ কিনে জমিতে লাগিয়েছিলাম। এছাড়া সার, কীটনাশকসহ অন্যান্য আনুসঙ্গিক খরচ তো আছেই। আমার দুই বিঘার সব পেঁয়াজই বিক্রি করেছি। এবার ফলন কিছুটা কম হয়েছে। ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি দরে সব পেঁয়াজ বিক্রি করা সত্ত্বেও উৎপাদন খরচ তোলাই কঠিন হয়ে পড়বে।"