গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে পায়রা এখন শুধু সমুদ্রবন্দর
পাঁচ বছর কর্মযজ্ঞের পর শেষ পর্যন্ত পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়িয়েছে সরকার। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানান, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে এসে, সেখানে সাধারণ সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আর এ জন্য বন্দরটির অবস্থান সমুদ্রের ভেতর থেকে সরিয়ে ৬৫ কিলোমিটার দূরে উপকূলবর্তী রাবনাবাদ চ্যানেলের মুখে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
এর অর্থ এই যে, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পায়রা বন্দরে এখন আর বৃহদাকার জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে না। চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দরের ন্যায় এখানেও অপেক্ষাকৃত ছোট জাহাজগুলোই চলাচল করবে।
এই মাসের শেষ নাগাদ কিংবা আগামী মাসের শুরুতে সরকার সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) ক্যাপিটাল ড্রেজিং এবং মেইনটেনেন্স ড্রেজিং পরিচালনায় বেলজিয়ান প্রতিষ্ঠান জান ডি নুলে'র সঙ্গে পাঁচ হাজার কোটি টাকার নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করবে।
এর আগে সরকার জান ডি নুলে'র সাথে ১১ হাজার কোটি টাকার সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) চুক্তি স্বাক্ষর করে। তবে, প্রতিষ্ঠানটি নিজে থেকে অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেয়ে চলেছিল।
প্রকল্পের রূপরেখা পরিবর্তনের সাথে সরকার এখন পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের জন্য নবগঠিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন তহবিল থেকে ঋণ প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে।
১৪ মাসের ভেতর খনন বা ড্রেজিং সমাপ্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করে খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানান, "বন্দরের জন্য ড্রেজিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের লক্ষ্য হল ৬৫ কিলোমিটার রাবনাবাদ চ্যানেল জুড়ে ১০ মিটার নাব্যতা বজায় রাখা।"
"আমাদের দেশ ঘূর্ণিঝড়প্রবণ হওয়ায় এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় সবথেকে বেশি আঘাত হানায়, আমরা এখানে গভীর সমদ্রবন্দর নির্মাণের কথা ভাবছি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন," বলেন প্রতিমন্ত্রী।
ফলে, বাংলাদেশে এখন কেবল মহেশখালির নিকট মাতারবাড়ীতে একটি মাত্র গভীর সমুদ্রবন্দর অবশিষ্ট রইল। ১৮ মিটার নাব্যতার সমুদ্রবন্দরটি বৃহদাকার জাহাজ চলাচলের জন্য যথেষ্ট।
প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, "আমরা মাতারবাড়ী থেকে লাইটারেজ জাহাজ ব্যবহারের মাধ্যমে চট্টগ্রাম, পায়রা ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারব।"
মাতারবাড়ীতে ১২০০ ওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের পাশাপাশি জাপান প্রদত্ত ঋণের সাহায্যে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প নির্মাণাধীন রয়েছে।
২০২২ সালের মধ্যে, আংশিকভাবে পরিচালিত পায়রা বন্দর মাল্টিপারপাস টার্মিনালসহ পূর্ণাঙ্গভাবে খুলে দেওয়া হবে, "২০৩৫ সালের মধ্যে বন্দরটি সকল ব্যয় পুনরুদ্ধারে সক্ষম হবে অর্থাৎ, ব্রেকইভেন পর্যায়ে পৌঁছাবে," বলেন তিনি।
পায়রা সমুন্দ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে। কয়লাভিত্তিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র ছাড়াও থাকছে কয়লা টার্মিনাল, রেলপথ, ব্রিজ, সড়কপথ এবং নগরায়ন পরিকল্পনা।
সম্প্রতি সরকার আন্ধারমানিক নদীর উপর চারশো কোটি টাকা ব্যয়ে ছয় লেনের ব্রিজ নির্মাণে টেন্ডার জারি করে। এক কিলোমিটার দীর্ঘ এই ব্রিজটি বন্দরের সাথে সড়কপথকে সরাসরি সংযুক্ত করবে।
এক নজরে পায়রা প্রকল্প
পায়রা সমুদ্র বন্দরের ১৯টি প্রকল্প রয়েছে। প্রাথমিকভাবে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল এগারো'শ কোটি ডলার থেকে পনের'শো কোটি ডলার। তিন ধাপে বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
পটুয়াখালির তেঁতুলিয়া নদীতে মেঘনার মোহনায় রাবনাবাদ চ্যানেলটি অবস্থিত। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এর দূরত্ব ২৭০ কিলোমিটার। অন্যদিকে, মংলা বন্দর থেকে প্রকল্পটি ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চ্যানেলটির উচ্চতা গড়ে দুই মিটার হওয়ার এবং আশেপাশে পতিত জমি থাকায় বন্দরের জন্য জায়গাটি নির্বাচন করা হয়। বর্ষার সময় এখানকার জমি পানিতে তলিয়ে যায় না। পাশাপশি, নৌপথ এবং সড়কপথের সাথে জায়গাটি সংযুক্ত।
ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান এইচআর ওয়ালিংফোর্ড অ্যান্ড কনসোর্টিয়াম পরিচালিত প্রযুক্তিগত সম্ভাব্যতা জরিপ অনুযায়ী, পায়রা বন্দর নির্মাণে সাত হাজার একর জমির প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে, ছয় হাজার একর জমি বন্দর উন্নয়নের কাজে ব্যবহৃত হবে। পাঁচশ একর জুড়ে থাকবে কয়লা টার্মিনাল এবং বাকি অংশ বন্দর নির্মাণে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনপদের পুনর্বাসনের জন্য রাখা হবে।
গবেষণাটিতে উক্ত অঞ্চলের আবহাওয়া এবং বাতাসের গতিপ্রকৃতিও মূল্যায়ন করা হয়। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য স্থানটি উপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত হয়।
২০১৬ সাল থেকে একাধিকবার প্রকল্পটির আর্থিক রূপরেখা পরিবর্তন করা হয়।
২০১৬ সালের মে মাসে সরকার জান ডি নুলে'র সঙ্গে প্রথমবারের মতো দুই বিলিয়ন ডলারের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দরের ক্যাপিটাল ড্রেজিং এবং মেইনটেনেন্স ড্রেজিংয়ের জন্য এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
২০১৭ সালে এক বছর মেয়াদী জরিপ গবেষণা পরিচালনার পর জান ডি নুল সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) চুক্তি স্বাক্ষর করে। রাবনাবাদ চ্যানেলে প্রায় ৩৫ নটিক্যাল মাইল (৬৫ কিলোমিটার) ক্যাপিটাল ড্রেজিং চালনার জন্য চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়।
২০১৮ সালের মধ্যে গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য ১৪ মিটার গভীরতা বা ড্রাফট বিশিষ্ট এবং ৩০০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ প্রবেশের জন্য চ্যানেলটি সচল করতে জান ডি নুল'কে নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি পিপিএর মাধ্যমে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করে।
অর্থায়নের রূপরেখা পরবর্তীতে পিপিএ মডেলে নিয়ে আসা হয় এবং পর্যায়ক্রমে জান ডি নুল জানায় তারা সরকারি জামানত ব্যতীত প্রকল্প তহবিল গঠন করতে পারবে না। তবে সরকার কোনো জামানত বা নিশ্চয়তা দিতে অসম্মতি জানায়।
পায়রা বন্দরের অন্যান্য সুবিধা
মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী বন্দর অঞ্চলে আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুবিধা এবং বন্দর জনপদের উন্নয়নের জন্য অনুমোদিত চুক্তিতেও বিলম্ব দেখা দিয়েছে।
২০১৬ সালের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৯ সালের মধ্যে রাজধানীর সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বিমানবন্দর নির্মাণ চুক্তি অনুমোদনের কথা ছিল। ফলে, পায়রা সহজেই আশেপাশের রিসোর্ট, ক্যাসিনো এবং সুন্দরবনের পর্যটকদের গ্রহণ করতে পারত।
সরকার শীঘ্রই ঢাকার সঙ্গে পায়রার সংযোগ স্থাপনে রেলপথ নির্মাণ করতে চায়। বন্দর পরিচালনা কার্যকরী করে তুলতে রেলপথ স্থাপন বন্দর উন্নয়নের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। সম্ভাব্যতা জরিপে মনে করা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে রেল সংযোগ স্থাপন সমাপ্ত হবে।
এছাড়াও এখানে বিদেশিদের জন্য বিশেষ পর্যটন অঞ্চল, ইকো পার্ক, মেরিন ড্রাইভ, মেরিন পার্ক, সামুদ্রিক অ্যাকুয়ারিয়াম, আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম, গলফ কোর্স, টেনিস কোর্ট, কনভেনশন সেন্টার, হোটেল জোন এবং রিসোর্ট, শপিং মল, পিকনিক স্পট এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এফডিআই ভিত্তিতে ২০১৮ সাল নাগাদ এক কিলোমিটার দীর্ঘ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল ঢাকা, মংলা এবং চট্টগ্রামে নৌপথ, সড়কপথ বা রেলপথে স্থানান্তরিত কনটেইনার ধারণে সক্ষম টার্মিনাল নির্মাণ।
এছাড়া পায়রায় এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের পরিকল্পনাও আছে। গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সার কারখানা এবং জাতীয় গ্যাস সরবরাহের জন্য আমদানিকৃত লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহে টার্মিনাল সুবিধার উদ্যোগ গৃহীত হয়।
পায়রাকে কেন উপকূলবর্তী অংশে স্থানান্তর করা হল
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাইক্লোন ঝড় নিয়ে উদ্বেগ ছাড়াও পায়রা বন্দরের কারণে চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা তা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল।
ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি এবং এই অঞ্চলে ভারত, চীন ও জাপানসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর স্বার্থও এই সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে।
তবে, ভবিষ্যতে পায়রা বন্দরকে গভীর সমুদ্র বন্দরে রূপান্তরিত করা যাবে কিনা তা নিয়ে সম্ভাব্যতা গবেষণা চলমান।
বর্তমানে, সরকার এখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল, তৈরি পোশাক কারখানা, ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান, সিমেন্ট কারখানা, কয়লাভিত্তিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র, মৎস্য প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল, সার কারখানা, তেল পরিশোধন এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ পায়রা প্রকল্পকে ঘিরে ১৯ টি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
এছাড়া, বুয়েটের ব্যুরো অব রিসার্চ, টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেশন (বিআরটিসি) এবং ডাচ প্রতিষ্ঠান রয়্যাল হাসকনিং ডিএইচভির সহায়তার অন্যান্য পরিকল্পনা বিষয়ক সম্ভাব্যতা জরিপ, সামাজিক ও প্রাকৃতিক প্রভাব মূল্যায়ন, ক্রয় পরিকল্পনা, ক্রয় প্রস্তাব গঠন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হবে। একইভাবে, বন্দর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক পরিকল্পনা, কৌশলগত শুল্ক পরিকল্পনা এবং পায়রা বন্দরকে গভীর সমুদ্র বন্দরে রূপান্তরিত করতে সম্ভাব্যতা জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে।