জ্বালানি খরায় যুক্তরাষ্ট্রমুখী হচ্ছে চীন, ইউরোপ চায় ত্রাণ পরিকল্পনা
চীনের অনেক অঞ্চলে দেখা দিয়েছে আসন্ন শীতের হিমেল আবহাওয়া। ফলে কয়লার দামে আরেক দফা রেকর্ড হয়েছে। তার সঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাসের আকাশছোঁয়া দামের কারণে দেশটির বড় বড় জ্বালানি কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী ক্রয় চুক্তির কথা ভাবছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে এ ব্যাপার নিশ্চিত করেছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
এশিয়া ও ইউরোপজুড়ে প্রায় সবগুলো দেশের সরকারের প্রধান এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। কয়লা ও গ্যাসের তড়িৎগতির মূল্য উল্মফনে বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যাপক ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। চীনে লোডশেডিংয়ে ব্যাহত হচ্ছে, বড় বড় শিল্প কারখানায় পণ্য উৎপাদন ও কাঁচামাল প্রক্রিয়াকরণ।
করোনাভাইরাস মহামারির বিপর্যয় থেকে বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধারকালে এ সংকটে পড়েছে অ্যাপল ইনকর্পোরেশনের মতো পৃথিবীর বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোতে সরবরাহকারীরাও।
জ্বালানির দর বাড়াচ্ছে মূল্যস্ফীতি। এ থেকে ভোক্তাদের সুরক্ষিত রাখতে প্রণোদনা ও ভর্তুকির মতো জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ভাবছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সরকারপ্রধানেরা। আগামী সপ্তাহে নির্ধারিত সম্মেলনে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
এদিকে বিশ্বের শীর্ষ রপ্তানিকারক চীনই জ্বালানি স্বল্পতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘাটতি পূরণে সিনোপ্যাক কর্প ও চায়না ন্যাশনাল অফশোর অয়েল কোম্পানির (সিএনওওসি) মতো প্রধান জ্বালানি কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি রপ্তানিকারকদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির ভিত্তিতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনার প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেছে।
সূত্রগুলির বরাতে রয়টার্স জানায়, আলোচনা সফল হলে হাজার হাজার কোটি ডলারের চুক্তি হবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনের এলএনজি আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে। ভূরাজনৈতিক নানা কারণে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উত্তেজনার সময়ে এমন চুক্তি হবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর আগে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ শুরুর সময়ে দুই দেশের মধ্যকার গ্যাস-বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়েছিল।
বেইজিংভিত্তিক এক জ্বালানি ট্রেডার রয়টার্সকে বলেন, "রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক সংস্থা হিসেবে জ্বালানি কোম্পানিগুলো সরবরাহের নিরাপত্তা নিয়ে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছে। কারণ, দরবৃদ্ধির বর্তমান ঘটনাগুলো চীনের শীর্ষ নেতৃত্বকে দীর্ঘমেয়াদী সরবরাহের ব্যাপারে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে।"
জ্বালানি সংকটের প্রতিকূলতা পৃথিবীর পরিবেশের ওপরও পড়েছে। কয়লা ব্যবহার কমানোর নীতি থাকা সত্ত্বেও পরিস্থিতির কারণে চীন ও ভারতের মতো বেশ কিছু দেশ আবার স্বল্পমেয়াদে কয়লানির্ভর হয়ে উঠেছে।
ভোক্তাদের খরচের চাপ কমাতেও উদ্যোগী হয়েছে বেইজিং। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি স্থানীয় কয়লার উৎপাদন বৃদ্ধির মতো বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে গণচীন সরকার। এমনকি অতিরিক্ত শক্তিনির্ভর কারখানায় কমানো হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ।
তারপরও শান্ত হচ্ছে না কয়লার উত্তাল বাজার।
আজ শুক্রবার কার্যদিবসের শুরুতেই দেশটির কয়লা বাজারের সবচেয়ে সক্রিয় সূচক ঝেংঝৌ কোল ফিউচার্স নাগাদ টনপ্রতি ১ হাজার ৬৬৯ ইউয়ান (২৯৫.৪২ ডলার) পর্যন্ত বেড়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর সূচকটিতে মোট মূল্যস্ফীতি হয়েছে ২০০ শতাংশ।
তবে চীন সরকার ভোক্তাদের শীত মৌসুমে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে বলে আশ্বস্ত করেছে।
তেল বাজারেও আগুন:
সুযোগ বুঝে ইউরোপকে পরিহাসই যেন করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। গেল সপ্তাহে তিনি বলেন, ইউরোপের কিছু রাজনীতিবিদ যদি মস্কোকে অনুরোধ কর, তাহলে অতিরিক্ত গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হবে।
রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম বড় প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানিকারক ও ইউরোপের সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক সরবরাহকারী। ইউরোপীয় কিছু রাজনীতিকের অভিযোগ, রাশিয়া জ্বালানি সংকটকে পুঁজি করে অন্যায় সুযোগ নিতে চাইছে। কিন্তু এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে মস্কো।
গ্যাস ও কয়লার অভাবে তেলের চাহিদা হু হু করে বাড়ার ফলে ২০১৪ সালের পর আজ শুক্রবার প্রথমবারের মতো ব্যারেলপ্রতি ৮৫ ডলার অর্জন করেছে ব্রেন্ট ক্রুডের মূল্যসূচক।
পরিস্থিতির চাপে ইইউ'কে ছাড়াও ইউরোপের কিছু দেশ একক সিদ্ধান্ত নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভোক্তাদের ওপর খুচরা মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে আজ শুক্রবার পোলান্ডের জলবায়ু মন্ত্রী ৩৮ কোটি ডলারের ভর্তুকি ঘোষণা করেছেন। নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য ভোক্তাদের বিলে আরোপিত সারচার্জ কমানোর কথা জানিয়েছে জার্মানি।
ডাচ ব্যাংক এবিএন আমরো সতর্ক করে বলেছে, ইউরোপে গ্যাসের পাইকারি মূল্য ২০২৩ সালের আগে স্বাভাবিক অবস্থানে নাও ফিরতে পারে।
অন্যদিকে, ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহৎ গ্যাস সরবরাহক নরওয়ে চলমান জ্বালানি সংকটে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। রপ্তানি বাড়ায় ও চড়া মূল্যের কারনে গত মাসে দেশটির বৈদেশিক বাণিজ্য রেকর্ড ২৮ শতাংশ বা ৫৩.৭ বিলিয়ন ক্রাউন (৬৩৭ কোটি ডলার)-এর বিশাল উদ্বৃত্ত অর্জন করে।
- সূত্র: রয়টার্স