ঝুঁকির মুখে মধ্যবিত্তের সঞ্চয়
বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় ব্যাংক খাতে অর্থ সুলভ ও সহজলভ্য।
ঋণগ্রহীতাদের জন্য সুদের নিম্নহার স্বস্তি এনে দিয়েছে। তবে বিপাকে পড়েছেন সঞ্চিত অর্থের সুদের ওপর নির্ভরশীল দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির আমানতকারীরা। ব্যাংকে টাকা জমা রেখে মুনাফার পরিবর্তে বর্তমানে লোকসান গুনছেন তারা।
দেশের অধিকাংশ ব্যাংক বর্তমানে সঞ্চিত হিসাবের বিপরীতে তিন থেকে চার শতাংশ হারে সুদ প্রদান করছে। অথচ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের হিসাব অনুযায়ী, দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতির তুলনায় সুদের এই হার অনেক কম।
গত বছর এপ্রিলে সব ধরনের ঋণের ওপর এক অংকের সুদহার নির্ধারণ করা হয়। বেশিরভাগ ব্যাংকই তখন তহবিল বাবদ ব্যয় বা কস্ট অব ফান্ডস তিন শতাংশের নিচে নিয়ে আসে। ফলে, আমানতকারীরাও লোকসানের মুখে পড়ে।
কেউ যদি ৪ শতাংশ সুদে ব্যাংকে ২৫ হাজার ১ টাকা গচ্ছিত রাখেন তাহলে বছর শেষে তিনি এক হাজার টাকা পাবেন।
কিন্তু আমানতকারীকে ব্যাংক হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ খরচ (অ্যাকাউন্ট মেইনটেনেন্স ফি) বাবদ বছরে দুই দফায় ২০০ টাকা করে মোট ৪০০ টাকা দিতে হবে। এছাড়া, রক্ষণাবেক্ষণের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট হিসেবে ৬০ টাকা এবং কর শনাক্তকরণ নাম্বার (টিআইএন) না থাকলে ১৫ শতাংশ কর হিসেবে মোট ১৫০ টাকা দিতে হবে। পাশাপাশি, ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ হারে মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় ২৫ হাজার ১ টাকার সঞ্চয়ে আরও এক হাজার ৪০৭ টাকা কমবে।
সর্বমোট দুই হাজার ১৭ টাকা কেটে নেওয়ার পর আমানতকারী সঞ্চয়ী হিসাবে এক হাজার ১৭ টাকা লোকসান গুনবেন। অর্থাৎ, বছর শেষে আমানতের পরিমাণ কমে দাঁড়াবে ২৩ হাজার ৯৮৩ টাকা।
মধ্যবিত্তের এই দুর্দশা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরেও এসেছে। গত সপ্তাহে নিয়ন্ত্রক ব্যাংকটি মহামারিকে কেন্দ্র করে চলতি বছরের জন্য হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কমিয়ে অর্ধেক করেছে।
২০২১ সালে যে সকল আমানতকারীর ব্যাংকে সঞ্চয়ী হিসাবে ১০ লাখ টাকার উপর আমানত আছে, তারা এই সুবিধা পাবেন। তবে চলতি হিসাবের জন্য বিশেষ এই সুবিধা প্রযোজ্য হবে না।
নতুন এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো এখন বছরে দুইবার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কাটার পরিবর্তে মাত্র একবার করে টাকা কেটে নিবে।
রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কমে যাওয়ায় আমানতকারীরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন। মেইনটেনেন্স ফি কাটার পর এখন আমানতকারীরা বছর শেষে ২৫ হাজার ১ টাকার আমানতে ৮১৭ টাকা লোকসান গুনবেন।
আমানতের অর্থ কমে যাওয়ার আশঙ্কায় ব্যাংকে সঞ্চয় জমা রাখার আগ্রহ কমছে। ফলে, হ্রাস পাচ্ছে মেয়াদি আমানতের হার।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে মেয়াদি আমানত বা টার্ম ডিপোজিটের হার ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অথচ, এক বছর আগে এই হার ছিল ১৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
তবে, মহামারির মাঝে সার্বিক আমানত হার বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারিতে এই হার ১৩ শতাংশে এসে পৌঁছেছে। গত বছর একই সময় এই হার ছিল ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মোহাম্মদ নাসেরের পর্যালোচনা অনুযায়ী, আমানতের লোকসান থাকা সত্ত্বেও তা গুরুতর রূপ নেয়নি, কেননা আমানতকারীদের উদ্বৃত্ত অর্থ অন্য কোথাও সঞ্চিত রাখার মতো বিকল্পও নেই।
তিনি আরও জানান, ক্ষুদ্র আমানতকারীদের জন্য সরকারি সঞ্চয় স্কিম বিকল্প হতে পারে। তবে, বাধ্যতামূলক টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নাম্বার) থাকার কারণে বিষয়টি সীমিত পর্যায়েই থাকছে।
'ক্ষুদ্র আমানতকারীদের সাধারণত টিআইএন থাকে না। সর্বোপরি লোকসান থাকা সত্ত্বেও তাদের ব্যাংকে টাকা রাখতে হয়,' বলেন তিনি।
মোহাম্মদ নাসের আরও জানান, 'উদ্ভূত পরিস্থিতিকে পেছনে রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাব রক্ষাণাবেক্ষণ খরচ কমিয়েছে। বিষয়টি ক্ষুদ্র আমানকারীদের সামান্য হলেও স্বস্তি দিবে।'
তবে নাসের মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এককভাবে মধ্যবিত্ত আমানতকারীদের পাশে দাঁড়াতে পারবে না। সঞ্চয় স্কিমে বিনিয়োগের সহজ শর্ত নিয়ে আসতে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
২০১৯-২০ অর্থবছরে, সরকার বাধ্যতামূলক টিআইএন এবং নগদ লেনদেন বন্ধ করাসহ সঞ্চয় স্কিমে বিনিয়োগে কড়াকড়ি শর্ত আরোপ করে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংক আমানত ব্যতীত ক্ষুদ্র আমানতকারীদের আর্থিক নিরাপত্তা প্রদানের ভিন্ন কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সুদের হার নমনীয় না হওয়ায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সরকার ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদানের ওপর এক অংকের সুদহার নির্ধারণ করে দেওয়ায় প্রতিযোগিতার কোনো সুযোগ নেই। একইসঙ্গে, ব্যাংকগুলোর মাঝে আমানত নিয়েও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ থাকছে না। ফলে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি শেষ পর্যন্ত লোকসানই দেখছে।
এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকও অন্য ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখছে। ব্যাংকাররাও সার্বক্ষণিক নিয়ম মেনে চলতেই ব্যস্ত থাকছেন। ফলে, তারাও আমানতকারীদের রক্ষায় নতুন ধরনের আমানত ব্যবস্থার উদ্ভাবনে নজর দিতে ব্যর্থ বলে মন্তব্য করেন জাহিদ হোসেন।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বর্তমান বাজার এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের মাঝে ঋণ এবং বিনিয়োগ সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যাংকের তারল্য বাড়ছে। এছাড়া প্রণোদনা প্রকল্পের মাধ্যমেও অর্থায়ন সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো আমানতের ওপর সুদের হার কমাতে বাধ্য হচ্ছে।
ব্যাংকগুলো বর্তমানে নতুন আমানত গ্রহণের বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। তহবিল বাবদ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কয়েকটি ব্যাংক মেয়াদী আমানতের সময়কাল পূর্ণ হলে নবায়ন করার পরিবর্তে সেগুলো ছেড়ে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি আরও জানান, আমানতে নিম্ন সুদহারের কারণে কিছু ব্যাংক গত এক বছরে বিপুল পরিমাণ আমানত হারিয়েছে। তবে, রেমিট্যান্স সরবরাহ সচল থাকায় সার্বিক আমানত বৃদ্ধির হার এখনো ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিনিয়োগ বিকল্প সীমিত বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ফেব্রুয়ারিতে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের আমানত হারের ভারযুক্ত গড় বা ওয়েটেড অ্যাভারেজ ছিল এক দশমিক ৭৩ শতাংশ। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে এই হার সর্বনিম্ন।
বেশকিছু বৃহদাকার বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানতের ভারযুক্ত গড় হার তিন শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছে।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী ব্র্যাক ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই হার ২ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অন্যদিকে, প্রাইম ব্যাংক ও সিটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই হার যথাক্রমে ২ দশমিক ৭৪ শতাংশ ও ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
বর্তমানে, দেশে মোট আমানত হিসাব বা ডিপোজিট অ্যাকাউন্টের সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি ৫৮ লাখ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, এর মধ্যে ৯০ শতাংশ হিসাবই মধ্যবিত্ত পরিবারের, যাদের আমানতের পরিমাণ ১০ লাখ টাকা কিংবা তারও কম।
এর আগে ২০১৯ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংক দশ লাখ টাকা কিংবা তার কম আমানতের হিসাবধারীদের নিম্ন সুদহারের জন্য পরিষেবা চার্জ থেকে নিষ্কৃতি দেয়।
আমানতকারীদের সঞ্চয়ী খরচ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক এক বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন ধারার আমানতধারীদের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে নিয়ে আসে।
বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ১০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে হিসাবধারীদের ১০০ টাকা করে দিতে হবে।
২৫ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ টাকা সঞ্চয়ী হিসাবের ক্ষেত্রে গ্রাহকরা ৫০০ টাকার পরিবর্তে ২০০ টাকা করে দিবেন।
দুই লাখ থেকে ১০ লাখ টাকার বিনিয়োগের বিপরীতে আমানতকারীদের পরিষেবা খরচ হিসেবে ২৫০ টাকা দিতে হবে। আমানতের পরিমাণ দশ লাখের বেশি হলে পরিষেবা খরচ ৩০০ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।