তিনটি থাকা সত্ত্বেও মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় নতুন আরেকটি নৌবন্দর!
৪৫ কিলোমিটার নৌপথের মধ্যে তিনটি নৌবন্দর থাকা সত্ত্বেও মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ২৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি নৌবন্দর স্থাপন করতে চায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
গজারিয়ার দাউদকান্দি সেতুর ডানপাশে মেঘনা নদীর তীরে ২৫ একর জায়গার উপর এ নৌবন্দর স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বহুমুখী এ নৌবন্দরে নৌপথের পাশাপাশি সড়ক ও রেলপথ সংযোগের পরিকল্পনা রয়েছে।
গজারিয়ার যে স্থানে নতুন নৌবন্দর স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে, ঠিক তার ৪৫ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে পানগাঁও কন্টেইনার টার্মিনাল; ১৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গার তীরে নির্মিত বন্দরটির কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৩ সালে।
২৭ কিলোমিটারের মধ্যে শীতলক্ষা নদীর তীরে নারায়ণগঞ্জের খানপুরে আরেকটি নৌ বন্দরের অনুমোদন দিয়েছে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি; যা নির্মাণ কাজ শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে। এর সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০-৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
পানগাঁও বন্দরটি বিআইডব্লিউটিএ ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে নির্মাণ করলেও বর্তমানে এটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া প্রস্তাবিত নৌ বন্দরের পাশে রয়েছে বেসরকারি সামিট গ্রুপের আরো একটি কন্টেইনার টার্মিনাল- যার বার্ষিক কন্টেইনার হ্যান্ডল ক্ষমতা ১২০,০০০ টিইইউ (পণ্য জাহাজিকরনের সক্ষমতা পরিমাপের একককে বলা হয় টিইইউ)
পানগাঁও বন্দরের বাৎসরিক কনটেইনার হ্যান্ডেলিং ক্ষমতা ১১৬,০০০ টিইইউ। বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এ বন্দর দিয়ে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হচ্ছে ২০০০০-২২০০ টিইইউর মতো। অর্থাৎ সক্ষমতার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে।
বিদ্যমান বন্দরের সক্ষমতা নিশ্চিত না করে বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করে আরেকটি বন্দরের পরিকল্পনা অর্থের অপচয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে বিআইডব্লিউটিএ মনে করছে সুযোগ থাকলে আরো উন্নতমানের বন্দর নির্মাণই শ্রেয়।
বিআইডব্লিউটিএ পরিচালক কাজী ওয়াকিল নওয়াজ (বন্দর ও পরিবহন বিভাগ), বলেন, "ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় নিয়ে গজারিয়ায় নৌ-বন্দর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পানগাঁও বন্দরের পূর্ণ সক্ষমতা এখনো কাজে না লাগলেও আগামীতে ভালো ফল আসবে"।
তিনি আরও বলেন, "এখন যেখানে সুযোগ আছে, সেখানে বন্দর স্থাপন করে ফেলাই ভষ্যিতের জন্য ভাল হবে"।
একই ভাবনা থেকে খানপুর নৌবন্দর নির্মাণ করা যৌক্তিক বলে মনে করেন তিনি।
ইতিমধ্যে প্রকল্পের প্রাথমিক প্রস্তাব নীতিগত সম্মতির জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। পাশাপাশি প্রকল্পটিতে বৈদেশিক অর্থায়ন নিশ্চিত করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি)।
তবে বিদ্যামান বন্দরের ব্যর্থতা নিরুপণ না করে নতুন করে বন্দর নির্মাণের প্রস্তাব গ্রহনযোগ্য নয় বলে মনে করেন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এবং পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক। একই সঙ্গে নতুন প্রস্তাব পাওয়ার পর আগের প্রকল্পের ব্যর্থতার কারণ খতিয়ে দেখতে পরিকল্পনা কমিশনকে পরামর্শ দেন তিনি।
শামসুল হক বলেন, "সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে পানগাঁও বন্দর তৈরি করার পর সে উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হলো বন্দরটি। এখন প্রায় একই জায়গায় আরেকটি বন্দর নির্মাণের বিষয়ে যে যুক্তিই দেখানো হোক, সেটি মুখ্য বিষয় না। দেখতে হবে আগের প্রকল্পটির ফলাফল কী। কোন প্রকল্প সফল না হলে বুঝতে হবে তার ফিজিবিলিটি স্টাডি (সম্ভাব্যতা যাচাই) ঠিকমত হয় নি। সেক্ষেত্রে আরেকবার এটি খতিয়ে দেখা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত একটি চর্চা। এটি যদি একই প্রতিষ্ঠানের হয় তবে তাকে পরিষ্কার করতে হবে কেন আগের প্রকল্পটি সফল হয়নি। পরিকল্পনা কমিশনের কাজ হবে এ বিষয়টি খুঁজে বের করা"।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য মোঃ মামুন-আল-রশীদ বলেন, "গজারিয়াতে নৌ-বন্দরের আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা, তা পরিকল্পনা কমিশন খতিয়ে দেখবে। তারপরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে কমিশন। যদি আশেপাশের বন্দর দিয়ে কাজ হয়, তাহলে গজারিয়ায় নতুন বন্দর করার প্রয়োজন হবে না"।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য জাফর আলম বলেন, "কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয় অথচ তা যদি ব্যবসায়ীরা ব্যবহার না করে তাহলে এ ধরণের প্রকল্প কোনো কাজে আসবে না| পানগাঁও বন্দর ব্যবহারে ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করতে অবকাঠামো সুবিধা ছাড়াও ৭০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক কমানো হয়েছে। তারপরও ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে গজারিয়ায় নতুন বন্দর করতে হলে সমীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত"।
পানগাঁও বন্দরের সক্ষমতা অব্যবহৃত থাকার কারণ হিসাবে অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, " নৌপথে পণ্য পরিবহন করলে যাতে সড়কের চেয়ে কম খরচ পরে এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি পোর্টের সাথে রেল সংযোগ থাকতে হবে। তা না হলে অভ্যন্তরীণ বন্দর ব্যবহার করলে পুনরায় সড়ক পরিবহনে খরচ করতে হবে। রপ্তানি ও শিল্প অঞ্চলগুলোতে রেললাইন বসাতে হবে, যা সরাসরি বন্দরের সাথে যুক্ত থাকবে। তা না হলে অভ্যন্তরীণ নৌপথ সফল হবে না।"
ব্যবসায়ীরা ইতিমধ্যে জানিয়েছেন, ছোট-হালকা জাহাজের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করা লাভজনক হবে না। এ কারণে তারা নৌপথের পরিবর্তে সড়কপথে কন্টেইনার পরিবহন করছে। আর এতে অলস পড়ে থাকছে পানগাঁও টার্মিনাল।
এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পানগাঁও আসতে হলে কিছু পথ সমুদ্র দিয়ে আসতে হয়। ফলে চট্টগ্রামের যে সব জাহাজে কন্টেইনার আনা হয়, সেগুলোকে সমুদ্রপথে চলাচলের জন্য আন্তর্জাতিক সনদের প্রয়োজন হয়। আর এ ধরণের জাহাজের নির্মাণব্যয়ও বেশি। এতে কন্টেইনার পরিবহনের খরচ বেশি।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে যদি নৌপথে বড় জাহাজে করে অনেকগুলো কন্টেইনার পানগাঁওয়ের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়ে, তাহলে অনেক কম খরচ পড়বে।
সীকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল হক বলেন, "ইতিমধ্যে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন টার্মিনালসহ প্রস্তাবিত নতুন বন্দর অঞ্চলের আশেপাশে বেশ কয়েকটি বন্দর রয়েছে। আগে চট্টগ্রাম থেকে এসব বন্দরে ৪.৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ আসত। এখন ৪.২ মিটারের বেশি ড্রাফটের জাহাজ আসতে পারে না। ড্রেজিং করে সমুদ্র থেকে পানগাঁওতে ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ আসার মতো নদীপথের নাব্যতা তৈরি করতে হবে। তখন খরচ কমবে, ব্যবসায়ীরা নৌপথ ব্যবহার করতে আগ্রহী হবে"।
"সুতরাং প্রথমে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে আমাদের নৌপথ তৈরি করতে হবে। এরপর নতুন বন্দর নির্মাণের বিষয়টি বিবেচনা করা যায়", যোগ করেন তিনি।