ফুলে-ফেঁপে উঠেছে রেফ্রিজারেটর বাজার
২০১৮ সালের পর দুই বছর সময়কালেই দেশের রেফ্রিজারেটর বাজার ১৩১ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৫৪৯ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
দেশজুড়ে বিদ্যুতায়ন ও নগরায়নের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান, ছোট পরিবার ও কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বিগত দশকে দেশের রেফ্রিজারেটরের বাজার দুই অংক হারে বেড়েছে। স্থানীয় উৎপাদনও এক্ষেত্রে রেখেছে ভূমিকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের গবেষণা উদ্যোগ প্রতিষ্ঠান মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশ (এমডব্লিউবি) পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সালের মধ্যে দেশের রেফ্রিজারেটর বাজার ৯০০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।
এমডব্লিউবি'র সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, 'আগামী দুই-তিন বছরে বাংলাদেশের রেফ্রিজারেটর বাজার বিলিয়ন ডলারের বাজার হতে যাচ্ছে।'
গত বছরের জুলাই-আগস্টে এমডব্লিউবি জরিপটি চালায়। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটি জানায়, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যেই গ্রাহকদের কম খরচে উচ্চ মানের রেফ্রিজারেটর সরবরাহ করতে সফল হয়েছে, এমনটাই বিশ্বাস বেশিরভাগ গ্রাহকের।
২০১০ সালের আগে দেশের রেফ্রিজারেটর বাজারের ৮০ শতাংশই ছিল বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর দখলে, বাকি ২০ শতাংশ ছিল স্থানীয় উঠতি ব্র্যান্ডগুলোর।
স্থানীয় উৎপাদন ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের জন্য সরকার সহায়ক নীতিমালা গ্রহণের কারণে ওয়ালটনের মতো দেশীয় কোম্পানিগুলো রেফ্রিজারেটর উৎপাদনে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ শুরু করে। যমুনা, ভিশন ও মিনিস্টারের মতো অন্যান্য ব্র্যান্ডও ধীরে ধীরে সম্ভাবনাময় এ বাজারে প্রবেশ করে।
সিঙ্গার, এলজি, শার্প ও হিটাচির মতো বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে বাজার অংশিদারত্ব হারাতে শুরু করে, শেষ পর্যন্ত বিদেশি অনেকে বাজারে টিকে থাকতে স্থানীয়ভাবে পণ্য উৎপাদনের দিকে এগোয়।
তবে পাই চার্টে ততদিনে স্থানীয় ও বিদেশি কোম্পানির অবস্থান পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় তাদের জন্য বাজারে জায়গা করে নেওয়ার আর তেমন সুযোগ ছিল না।
২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী, দেশীয় বাজারের ৮০ শতাংশ বর্তমানে দেশি ব্র্যান্ডগুলোর দখলে, বাকি ২০ শতাংশ বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর। সংশ্লিষ্ট তথ্য উপস্থাপন করে এসব জানিয়েছে মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশ।
এমনকি দুই দশক আগে রেফ্রিজারেটরের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে শুরু করলেও সার্বিক চিত্র বদলে যাওয়ার শুরু এক দশক আগে; সে সময়ই গ্রামাঞ্চলের পরিবারগুলো রেফ্রিজারেটর ব্যবহার শুরু করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মো. নাজমুল হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, স্থানীয় উৎপাদন প্রক্রিয়ার ফলে বিগত দশকে ইউনিটপ্রতি দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, দেশের গ্রাম ও উপ-শহরাঞ্চলে মানুষের আয় বৃদ্ধি, যৌথ পরিবার ভেঙে ছোট পরিবারের সৃষ্টি, অধিক সংখ্যক নারীর কর্মক্ষেত্রে যোগদান ও বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ- এসব কারণে বিগত দশকে রেফ্রিজারেটরের চাহিদা বেড়েছে।
তবে, বাজারের অবস্থা সবখানে এক রকম নয়।
সাধারণ রেফ্রিজারেটরই (যেসব রেফ্রিজারেটরে বরফ জমে যায়) বেশি সাশ্রয়ী; মোট বিক্রির ৮০ শতাংশই আসে এসব রেফ্রিজারেটর থেকে। বার্ষিক ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে এই রেফ্রিজারেটরের বাজার।
নন-ফ্রস্ট রেফ্রিজারেটর (বরফ জমে না- এমন উন্নত প্রযুক্তির রেফ্রিজারেটর) দাম তুলনামূলক বেশি। ২০১৯ সালে দেশে তিন লাখেরও কম নন-ফ্রস্ট রেফ্রিজারেটর বিক্রি হয়।
এমডব্লিউবি'র গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গ্রাহকদের ক্রমবর্ধময়ান ক্রয়ক্ষমতা ও মানসম্মত পণ্যের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ খাতের এ অংশের ৪০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।
ঘরে দ্বিতীয় রেফ্রিজারেটর হিসেবে অনেকেই চেস্ট ফ্রিজার ব্যবহার করেন। এসব রেফ্রিজারেটরের বিক্রির দুই অংক হারে বাড়ছে।
এমডব্লিউবি'র গবেষণায় বলা হয়, গ্রাহকরা স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর স্বয়ংক্রিয় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ইনভার্টার টেকনোলজি, রিয়েল-টাইম টেম্পারেচার ডিসপ্লে, হলিডে মোড, টার্বো মোড, সুপারকুল মোড ইত্যাদি উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে সন্তুষ্ট।
জরিপে উঠে আসা তথ্যানুযায়ী, কিছু স্থানীয় ব্রান্ডের সার্ভিস লাইফও আকৃষ্ট করেছে গ্রাহকদের; বেশিরভাগ গ্রাহকই স্থানীয় ব্র্যান্ডের ইতিবাচক দিক হিসেবে সহজ ক্রয় প্রক্রিয়া, ইনস্টলমেন্ট সুবিধা, ওয়ারেন্টি ও বিক্রয়োত্তর সেবার কথা উল্লেখ করেছেন।
তবে স্থানীয় ব্র্যান্ডের কিছু গ্রাহক কুলিং (ঠাণ্ডা করার প্রযুক্তি), লিকেজ, কম্প্রেসর থেকে শব্দ নির্গত হওয়া, অত্যধিক বরফ জমে যাওয়া, সময়ের সঙ্গে কম্প্রেসরের সক্ষমতা কমে যাওয়া- এসব ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়েছেন।
অবশ্য স্থানীয় উৎপাদন বিশেষজ্ঞরা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি শিখে নেওয়ায় বর্তমানে এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত বাধা নেই। ইতোমধ্যেই তারা রেফ্রিজারেটরের বিভিন্ন পার্টস উৎপাদনে দক্ষতা অর্জন করেছেন।
রেফ্রিজারেটরের বাজারের অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান ওয়ালটনের দখলে রয়েছে বাজারের ৬৬ শতাংশ। ওয়ালটনের সহযোগী ব্র্যান্ড মার্সেলের দখলে আছে ৫ শতাংশের বেশি; ব্রান্ডটি এশিয়ার ৮ম কোম্পানি হিসেবে কম্প্রেসর উৎপাদন করছে।
এশিয়া, আফ্রিকা, পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের কিছু দেশসহ ওয়ালটন বর্তমানে ৪০টি দেশে রেফ্রিজারেটর রপ্তানি করছে।
প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যেই তাদের মিশন ২০৩০ ঘোষণা করেছে। বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ ইলেকট্রনিকস ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্যের তালিকায় আসার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এর মাধ্যমে।