বাংলাদেশ থেকে ভারতে ভোজ্যতেল রপ্তানিতে জটিলতা
নিজেদের ঢিলেমিতে সাফটার আওতায় ভারতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় এডিবল অয়েল রপ্তানির সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রপ্তানি হওয়া ভোজ্যতেল ও প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়ালের কান্ট্রি অব অরিজিন সার্টিফিকেট নিয়ে ভারতের সন্দেহ দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশের এডিবল অয়েল কোম্পানিগুলো ইন্সপেকশন করতে চাচ্ছে ভারতের কাস্টমস কর্মকর্তারা।
ভারতের এ প্রস্তাবে রাজি নয় বাংলাদেশ। ফলে ভারত সরকারের আরোপিত নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ারের কারণে দু'বছর ধরে কার্যত বন্ধ থাকা এডিবল অয়েল রপ্তানির দুয়ার সাহসা খুলছে না।
সাউথ এশিয়া ফ্রি ট্রেড এরিয়া- সাফটা চুক্তির আওতায় স্থানীয়ভাবে ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজন সাপেক্ষে সয়াবিন, পাম অয়েল রপ্তানিতে ভারতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ভোজ্যতেল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশে উৎপাদিন সয়াবিন, আমদানি করা ক্রুড অয়েল ও আমদানি করা সয়াসিড ক্র্যাস্ট করে ভোজ্যতেল উৎপাদন করে। এতে মূল্য সংযোজনের হার ৩০ শতাংশেরও বেশি।
তাহলে সমস্যা কী? তিন বছর আগে বাংলাদেশ যখন ভারতে ভোজ্যতেল রপ্তানি শুরু করে, তখন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ইস্যু করা কান্ট্রি অব অরিজিন সার্টিফিকেটে কিছু কিছু চালানে বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তখন ভারতের মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশ নিজেই যখন আমদানি করে চাহিদা মেটায়, সেখানে নিজেদের উৎপাদিত তেল রপ্তানি করছে কীভাবে?
বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ক্রুড অয়েল ও সয়াসিড আমদানি করলেও দেশে দিন দিন সয়াবিনের উৎপাদন বাড়ছে। মার্কিন কৃষি বিভাগের ফরেন অ্যাগ্রিকালচারাল সার্ভিসেসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের উৎপাদিত সয়াবিনের পরিমাণ ৩.২৫ লাখ টন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ভোজ্যতেল রপ্তানি বাড়তে শুরু করলে ইপিবির ইস্যু করা কান্ট্রি অব অরিজিন সার্টিফিকেটের ভেরিফিকেশন করে জানাতে বাংলাদেশকে অনুরোধ করে ভারত। নিয়মানুযায়ী, অনুরোধ পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে সাড়া দেওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশ তা করেনি। ফলে ভারতের সন্দেহ আরও ঘনিভূত হয়েছে।
এ প্রেক্ষিতেই দেশটির কাস্টমস কর্মকর্তারা বাংলাদেশের এডিবল অয়েল কোম্পানিগুলো ইন্সপেকশন করে উৎপাদিত ভোজ্যতেলের আমদানি তথ্য, মূল্য সংযোজনের হার, প্যাকেজিং মেটারিয়াল আমদানি ও তাতে মূল্য সংযোজনের হার ইত্যাদি যাচাই করার প্রস্তাব দিয়েছে।
বাংলাদেশ ছাড়াও নেপালসহ কয়েকটি দেশ থেকে ভোজ্যতেল রপ্তানি বাড়তে থাকলে ভারতের ভোজ্যতেল মিলারদের সংগঠন Solvent Extractors Association of India (SEA) দেশটির ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেডের কাছে আবেদনে ডাম্পিং করার অভিযোগ তোলে।
গত বছর মে মাসে পরিশোধিত পাম অয়েল আমদানির লাইসেন্স বাতিল করে ভারত। ওই সময় বাংলাদেশ হতে ১২ হাজার টন পাম অয়েল রপ্তানি আটকে যায়। তখন থেকে পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ রয়েছে।
বর্তমানে টিনভর্তি বা বোতলজাত সয়াবিন রপ্তানি হলেও যে টিন বা প্লাস্টিক বোতলে ভোজ্যতেল রপ্তানি হচ্ছে, তার মূল্য সংযোজনের হার নিয়েও সন্দেহ করছে ভারত। কান্ট্রি অব অরিজিন সার্টিফিকেটের কোনো কোনোটিতে ওই টিন বাংলাদেশে উৎপাদিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ তথ্যও যাচাই করতে চাইছে ভারত।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সাফটা চুক্তির বাইরেও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আলাদা সমঝোতা রয়েছে। তাতে ২০ শতাংশ মূল্য সংযোজন হলেই শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দেওয়ার কথা। পরিশোধিত সয়াবিন তেল, প্লাস্টিকের বোতল ও টিন- প্রত্যেকটিতে বাংলাদেশের মূল্য সংযোজন ৩০ শতাংশের বেশি।
সাফটা চুক্তি অনুযায়ী, যদি কোনো আমদানিকারক দেশ মনে করে, রপ্তানিকারক দেশের নামে তৃতীয় কোনো দেশ থেকে পণ্য রপ্তানি হচ্ছে, তাহলে রপ্তানিকারক দেশের সম্মতিতে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ভিজিট করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ভারত যেভাবে বাংলাদেশের এডিবল অয়েল কোম্পানিগুলো ইন্সপেকশন করতে চাচ্ছে, তাতে আপত্তি রয়েছে বাংলাদেশের।
বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বাংলাদেশে এসে কারখানা ইন্সপেকশন করার ভারতীয় প্রস্তাব আমাদের জন্য অপমানজনক। তাই এডিবল অয়েল কোম্পানিগুলোকে ইন্সপেকশন করতে ভারতের কাস্টমস কর্মকর্তাদের অনুমতি দেওয়া হবে না।'
তিনি বলেন, 'ভারত নতুন করে অ্যালয় স্টিল স্ক্র্যাপ অ্যান্ড ম্যাগানিজ স্টিল মেল্টিং স্ক্র্যাপ রপ্তানির ক্ষেত্রে কান্ট্রি অব অরিজিন সার্টিফিকেটের তথ্যের সঠিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। তারা এটিও ভেরিফিকেশন অনুরোধ পাঠিয়েছে। এ বিষয়েও বাংলাদেশের আপত্তি রয়েছে।'
'ভারতের নতুন কাস্টমস নীতিতে রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্যবসায়িক তথ্য নেওয়া হবে, যা সাফটা চুক্তির লঙ্ঘন। এটিসহ সার্বিক বাণিজ্য বিষয়াদি নিয়ে বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের আগামী বৈঠকে আলোচনা হবে। আগামী ৩ মার্চ ঢাকায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে,' যোগ করেন বাণিজ্য সচিব।
২০১৭ সালে ভারত ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর পর বাংলাদেশের মিলগুলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলী রাজ্যগুলোতে ভোজ্যতেল রপ্তানি শুরু করে। মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ ও সেনা কল্যাণ সংস্থাকে ভোজ্যতেল রপ্তানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
সাফটার আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যে ভারতে ভোজ্যতেল রপ্তানি বাড়তে থাকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ভারতে ভোজ্যতেল রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৩.৪০ মিলিয়ন ডলার।
এ পরিস্থিতিতে ভোজ্যতেল রপ্তানি ঠেকাতে ভারত শর্তারোপ করে বলে, ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্সের (ডিআরআই) 'নো অবজেকশন সার্টিফিকেট' ছাড়া বাংলাদেশ থেকে ক্রুড কিংবা পরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি করা যাবে না। তারপর থেকেই ভারতে বাল্ক আকারে ভোজ্যতেল রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। পরের প্রান্তিকে বাংলাদেশ থেকে এডিবল অয়েল রপ্তানি নেমে আসে ৩.৮৫ মিলিয়ন ডলারে।
এখন টিনে বা বোতলে পরিশোধিত সয়াবিন তেল রপ্তানি হচ্ছে। এসব রপ্তানির অনুকূলে ইপিবির ইস্যু করা কান্ট্রি অব অরিজিনে উল্লেখিত মূল্য সংযোজনের হার নিয়ে প্রশ্ন তুলে তা যাচাই করতে গত জানুয়ারিতে চিঠি দিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী।
চিঠিতে তিনি লিখেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতে পরিশোধিত সয়াবিন রপ্তানির ক্ষেত্রে ইপিবির ইস্যু করা কান্ট্রি অব অরিজিন সার্টিফিকেটের তথ্যের সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন। এজন্য চিঠির সঙ্গে একটি কোয়েশ্চনেয়ার সংযুক্ত করে তার উত্তর চেয়েছে ভারতের হাইকমিশন। একই সঙ্গে ভোজ্যতেল রপ্তানির ক্ষেত্রে ইমপোরটেড টিনের দাম সম্পর্কেও জানতে চাওয়া হয়েছে এতে।
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা টিবিএসকে বলেন, 'সাফটার আওতায় বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার যোগ্য হলেও ভোজ্যতেল রপ্তানিতে ভারত এ সুবিধা দিতে আগ্রহী নয়। এ কারণেই ভারতের ভোজ্যতেল রপ্তানি বন্ধ রয়েছে।'
এদিকে, গত তিন অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি চালানের সংখ্যা এবং ভারত থেকে বাংলাদেশ রপ্তানি চালানের সংখ্যা জানতে চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছর হতে গত অর্থবছর পর্যন্ত ভারত থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি হওয়া চালানের মধ্যে কয়টি সাফটার আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় খালাস পেয়েছে এবং বাংলাদেশ কয়টি কান্ট্রি অব অরিজিন ভেরিফাই করার জন্য ভারতে পাঠিয়েছে, সে তথ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠকের আগেই জানতে চেয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সদস্য মোস্তফা আবিদ খান টিবিএসকে বলেন, 'বাংলাদেশ থেকে ভোজ্যতেল রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারত আমদানিকারকদের লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু দেশটি আমদানিকারকদের অনুকূলে লাইসেন্স ইস্যু করছে না। এ কারণেই ভারতে ভোজ্যতেল রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতে এসব সমস্যা সমাধান সম্ভব।'