বেনাপোলে ভয়াবহ যানজটে স্থবির আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য
দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোলে চলছে স্মরণকালের দীর্ঘতম যানজট। ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। ভোগান্তিতে পড়েছেন ব্যবসায়ী, পথচারীসহ ভারত চলাচলকারীরা।
সীমান্তের দুই প্রান্তে ট্রাক টার্মিনাল না থাকায়, বেনাপোল বন্দরে আসা পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে সড়কের ওপর রাখেন চালকরা। এতে ছয় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তৈরি হয়েছে যানজট।
একমাস ধরে বেনাপোল বন্দরে রপ্তানির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে প্রায় দুই হাজার পণ্যবাহী ট্রাক। ফলে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জরুরি কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্য আমদানিও ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিদিন শতাধিক ট্রাক পণ্য আমদানি কমে গেছে।
দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকা এসব গাড়ির তেল, ব্যাটারি, মালামাল, কাগজপত্র, মোবাইল ফোন, ম্যানিব্যাগ ও টাকা-পয়সা চুরির অভিযোগ আসছে।
নৈশপ্রহরী পরিচয়ে চাঁদাবাজিও বেড়েছে। যানজটে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন বন্দর ও আশেপাশের এলাকায় বসবাসকারী মানুষজন।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণে ও রপ্তানি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বেশি রপ্তানি পণ্যের ট্রাক না নেওয়ায় এখানে যানজট শুরু হয়েছে। এছাড়া, হঠাৎ করে রপ্তানি বেড়ে যাওয়ায় ও পণ্যবাহী ট্রাক বেশি আসায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, বেনাপোল স্থলবন্দরের বিপরীতে ভারতের পেট্রোপোল বন্দরের জায়গা সংকটের কারণ দেখিয়ে, রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে ভারত।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এই সংকট কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হচ্ছে। ভারত প্রতিদিন এ বন্দর দিয়ে বাংলাদেশে ৩৫০-৪০০ ট্রাক পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করলেও, বাংলাদেশি পণ্য নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা বরাবরই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। ভারত আগে ১৫০-২০০ ট্রাক রপ্তানি পণ্য গ্রহণ করলেও বর্তমানে ১০০-১২০ ট্রাক পর্যন্ত পণ্য গ্রহণ করছে। দফায় দফায় আলোচনা করেও সুরাহা করা যায়নি যানজটের।
এমন অবস্থার কারণে রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিদিন একেকটি ট্রাককে পণ্য পরিবহনের ভাড়ার পাশাপাশি দুই হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ গুনতে হচ্ছে। সময়মতো এসব পণ্যবাহী ট্রাক গন্তব্যে যেতে না পারায়, কোটি কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন এদেশের রপ্তানিকারকরা।
কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ভালো পরিমাণে রপ্তানি বেড়েছে।
২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই মাসে বেনাপোল দিয়ে ভারতে রপ্তানি হয় ২৭৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা মূল্যের ২৬ হাজার ৩৫ মেট্রিক টন পণ্য। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮৪ কোটি তিন লাখ টাকা মূল্যের ২৪ হাজার ৭১০ টন পণ্য।
২০২০-২১ অর্থবছরের আগস্ট মাসে রপ্তানি হয় ২৫৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা মূল্যের ২৩ হাজার ১১৫ টন পণ্য। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের আগস্ট মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪০ কোটি ৯২ লাখ টাকা মূল্যের ৩০ হাজার ৩৯৩ টন পণ্যে।
২০২০-২১ সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানি হয় ৬০০ কোটি ৮১ লাখ টাকা মূল্যের ৩৯ হাজার ৩৮৩ টন পণ্য। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৩৩২ কোটি ১৬ লাখ টাকা মূল্যের ৭৭ হাজার ৩৫০ টন পণ্যে। গত বছর থেকে এ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রপ্তানি বেড়েছে ৪৩ হাজার ৫৭০ মেট্রিক টন পণ্য।
বেনাপোল ট্রাক-লরি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহীন জানান, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণে সয়াবিনের ভূষি, পাট ও পাটজাত দ্রব্য এবং গার্মেন্টস, সাবান, ব্যাটারি, গার্মেন্টস ঝুট ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। প্রতিদিন এসব পণ্য নিয়ে ২০০-২৫০ ট্রাক ভারতে প্রবেশের জন্য বেনাপোল বন্দরে আসছে। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মাত্র ১০০-১২০টি ট্রাক গ্রহণ করছে। এ কারণে বেনাপোল বন্দর এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া বেনাপোল বন্দরে রপ্তানি পণ্যের ট্রাক রাখার কোনো টার্মিনাল নেই।
আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল লতিফ বলেন, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন বেনাপোল বন্দর দিয়ে ১৫০ ট্রাক তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানি হয়। গত দুই বছর বাংলাদেশি পণ্য ভারতে দ্রুত রপ্তানি করা সম্ভব হলেও, বর্তমানে যানজটের কারণে তা কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া, ভারতীয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি পণ্য গ্রহণে 'ধীরগতি নীতি' অনুসরণ করায় রপ্তানি বাণিজ্যে সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা। এর ফলে আমদানি করা পণ্য আসতেও অনেক দেরি হচ্ছে।
ইন্দো-বাংলা চেম্বার অফ কমার্স উপ-কমিটির পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, বেনাপোল বন্দর দিয়ে আগে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ ট্রাক বিভিন্ন ধরনের মালামাল আমদানি হতো। বর্তমানে এই আমদানির কমে দাঁড়িয়েছে অর্ধেকে। রপ্তানি পণ্য নিয়ে কয়েক হাজার ট্রাক সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে আছে দিনের পর দিন। বন্দরের এ অবস্থা চলতে থাকলে, খুব তাড়াতাড়ি দেশে বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামালের সংকট তৈরি হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এখনই যদি দ্রুত বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে যেকোনো সময় বন্ধ হতে পারে দুই দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, বেনাপোল বন্দর দিয়ে রপ্তানি বেড়েছে দ্বিগুণ। কিন্তু বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন হয়নি সেইভাবে। রপ্তানি পণ্যের ট্রাক রাখার কোনো টার্মিনাল না থাকায় প্রধান সড়কসহ আশেপাশের সড়কে ট্রাক রাখতে হচ্ছে। ফলে বেনাপোল বন্দর এখন কার্যত অচল।
বেনাপোল বন্দরের উপ-পরিচালক মামুন কবির তরফদার বলেন, ভারতের পেট্টাপোল বন্দর হয়ে পণ্য আমদানি বাড়ার পাশাপাশি রপ্তানিও বেড়েছে দ্বিগুণ। পণ্যবোঝাই শত শত ট্রাক ভারতে প্রবেশের অপেক্ষায় বেনাপোল বন্দর, বন্দরের আশেপাশে ও প্রধান সড়কে অবস্থান করছে। এতে বন্দর এলাকায় আমদানি-রপ্তনি পণ্য খালাস ব্যাহত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, 'রপ্তানি বাণিজ্য গতিশীল করতে সম্প্রতি ভারতের পেট্টাপোল বন্দরের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ওপাড়ের টার্মিনালে জায়গা না থাকায় তারা বেশি ট্রাক নিতে অপারগতা প্রকাশ করছেন। এছাড়াও, প্রতিদিন যাতে বেশি বেশি ট্রাক পণ্য ভারতে রফতানি করা যায় সে বিষয়ে আমরা রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছি।'
বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. আজিজুর রহমান বলেন, বন্দর এলাকায় স্মরণকালের ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে আমদানি বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়াও। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।