বেনাপোল-পেট্রাপোলে ট্রাকজট, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশি আমদানিকারকরা
বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি বেড়েছে ভারতে। মাস দুয়েক ধরে এই স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি বেড়ে যাওয়ায় কিছুটা জট লেগেছে পণ্যবাহী ট্রাকের। লকডাউনের সময় যেখানে দিনে শতাধিক ট্রাক পণ্য যেত, এখন যাচ্ছে তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ ট্রাক। একই সময়ে আমদানিও বেড়েছে দেশের অন্যতম এই স্থলবন্দর দিয়ে। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে তিনশ ট্রাকে পণ্য আমদানি হচ্ছে। লকডাউনের সময় আসত দেড়শ।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে দেখা দিয়েছে পণ্যবাহী ট্রাকের ভয়াবহ জট। বাংলাদেশে আমদানি পণ্যবাহী প্রায় ৮ হাজার ট্রাক কালিতলা পার্কিংয়ে সিরিয়ালে রয়েছে। এই সিরিয়ালে থাকতে প্রতিদিনই চাঁদা দিতে হচ্ছে। যেখানে বেনাপোল বন্দরে এ ধরনের চাঁদা ভারত বা বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের দিতে হয় না।
বেনাপোল সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, "লকডাউনের সময় রপ্তানির হার অনেক কমে যায়। গত দুই মাস ধরে তা তিনগুণেরও বেশি হয়েছে। আবার আমদানিও বেড়েছে। এতে উভয় বন্দরে দেখা দিয়েছে পণ্যবাহী গাড়ির জট।
তিনি বলেন, "বনগাঁ পৌরসভা পার্কিংয়ে রাখা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা ট্রাক থেকে চাঁদা নেয়া হচ্ছে। প্রতিদিন ছোট গাড়ি ৫০ টাকা, ৬ চাকার গাড়ি ৮০ টাকা, ১০ চাকার গাড়ি ১২০ টাকা ও ট্রলার ১৬০ টাকা হারে পার্কিং চার্জ আদায় করে থাকে। এতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।"
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের ২৩টি স্থলবন্দরের মধ্যে অন্যতম বেনাপোল স্থলবন্দর। এ বন্দর থেকে ভারতের কলকাতা শহরের দূরত্ব ৮৪ কিলোমিটার। মাত্র ৩ ঘণ্টায় একটি পণ্যবাহী ট্রাক পৌঁছাতে পারে কলকাতায়। আবার একই সময়ে কলকাতা থেকে পণ্যবাহী ট্রাক পৌঁছায় বেনাপোল বন্দরে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় এ পথে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে প্রবল আগ্রহ ব্যবসায়ীদের। প্রতিবছর এ বন্দর দিয়ে প্রায় ৮০ হাজার মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হচ্ছে। আমদানি বাণিজ্য থেকে সরকারের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা এবং রপ্তানি বাণিজ্য থেকে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। প্রতি বছর ৬০ হাজার কোটি টাকার পণ্য এই স্থলবন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। সরাসরি প্রায় ২০ হাজার মানুষ এবং পরোক্ষভাবে সব মিলিয়ে ৫০ হাজার মানুষ নির্ভরশীল এই স্থলবন্দরের ওপর।
আমদানি পণ্যের মধ্যে গার্মেন্টস সামগ্রী, শিল্পকারখানা ও ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল, শিল্প প্রতিষ্ঠানের মূলধনী যন্ত্রপাতি, কেমিক্যাল, চাল-পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য, তুলা, বাস- ট্রাকের চেসিস, টায়ার, মোটরসাইকেল এবং মোটরসাইকেলের খুচরা যন্ত্রাংশ ইত্যাদি রয়েছে।
রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে পাট ও পাটজাত দ্রব্য, টিস্যু, ধানের কুড়া, সাদা মাছ, ব্যাটারি, সিরামিক টাইলস, সাবান, হাড়ের গুড়া এবং বিভিন্ন ধরনের গার্মেন্টস পণ্য।
বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার মো. আজিজুর রহমান বলেন, "লকডাউনের সময় বেনাপোল দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য কমে যায়। কিন্তু গত দুই মাস ধরে আমদানি-রপ্তানি বেড়েছে। আগে যেখানে শতাধিক ট্রাক রপ্তানি হতো, এখন সেখানে তিন থেকে সাড়ে তিনশ ট্রাক পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। আমদানি হচ্ছে তিন থেকে সাড়ে তিনশ ট্রাক পণ্য। এতেও ওপারে জট সৃষ্টি হয়েছে। আমরা বিষয়টি ভারতীয় হাইকমিশনে লিখিতভাবে জানালেও কাজ হয়নি।"
তিনি বলেন, "পেট্রাপোলে অবৈধভাবে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পার্কিংয়ের নামে টাকা আদায় করা হচ্ছে। এজন্য সেখানে সিরিয়াল দিতে হয়। এসব কারণে আমদানি পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দীর্ঘ সময় লাগছে। এতো সময় না লাগলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এই বন্দর দিয়ে আরও বাড়ত।"
বেনাপোল বন্দরের উপপরিচালক মামুন কবীর বলেন, "পেট্রাপোলে ভয়াবহ জট লেগেছে। আবার রপ্তানিবাহী ট্রাকের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে আমাদের বন্দরে কিছুটা জট সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছি। পেট্রাপোলে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে প্রায় ৮ হাজার পণ্যবাহী ট্রাক। ট্রাকজটের কারণে তারা প্রবেশ করতে পারছে না।"
ইন্দো-বাংলা চেম্বার অব কমার্স সাব কমিটির পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, "পেট্রাপোলে বনগাঁ পৌরসভার মেয়রের নেতৃত্বে অবৈধ পার্কিং গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে আমাদের আমদানিকারকদের কাছ থেকে জোরপূর্বক টাকা আদায় করা হচ্ছে। এতে একটি ট্রাক বেনাপোলে প্রবেশ করতে এক মাসের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। এর ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারকে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।"
পেট্রাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, "বনগাঁও পৌরসভার তত্ত্বাবধানে সিরিয়ালের নামে এসব ট্রাক কালিতলা পার্কিংয়ে ঢোকানো হচ্ছে। যেখানে বর্তমানে ৮ হাজারের বেশি ট্রাক দাঁড়িয়ে রয়েছে। এ চাঁদাবাজি বন্ধ হলে বাংলাদেশে দ্রুত পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হবে।"
বেনাপোল বন্দর সূত্র জানায়, এই স্থলবন্দর দিয়ে ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত ৫ বছরে রপ্তানি হয় ১৮ লাখ ৫১ হাজার ২৫৭ মেট্রিক টন পণ্য। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৪ লাখ এক হাজার ১৭৭ মেট্রিক টন ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৮২৯ মেট্রিক টন পণ্য। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ২ লাখ ৯৭ হাজার ৪৮ মেট্রিক টন পণ্য।