বেনাপোল স্থলবন্দরে ২০ বছরেও লোকবল বাড়েনি
দেশের স্থলবন্দরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ব্যস্ততম স্থলবন্দর বেনাপোল। ফলে অন্য বন্দরগুলোর তুলনায় এ বন্দরের জনবলও বেশি নিয়োগ হওয়ার কথা, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এখনও কম জনবল নিয়ে কাজ করছে এই বন্দরটি।
গত ২০ বছরেও বেনাপোল কাস্টম হাউজে লোকবল নিয়োগ করা হয়নি। সর্বশেষ ২০১৮ সালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিদের ১৮২টি শূন্যপদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আহবান করলেও সেটির বাস্তবায়ন হয়নি। কর্তৃপক্ষ বলছেন, করোনাকালে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যাচ্ছে না।
বেনাপোল কাস্টম হাউজ চালু হয় ২০০০ সালে। এর আগে মোংলা কাস্টমের অধীনে ছিল তারা। গত ২০ বছরেও বেনাপোল কাস্টম হাউজে লোকবল নিয়োগ করা হয়নি। এতে কাজের জট লেগে যাচ্ছে প্রায়ই কাস্টম হাউজটিতে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিদের ১৮২টি শূন্যপদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আহবান করা হলেও সেটির বাস্তবায়ন হয়নি।
কাস্টম সূত্রে জানা গেছে, বেনাপোল কাস্টমস হাউজে মোট মঞ্জুরিকৃত পদের সংখ্যা ৩৩৬টি। এর মধ্যে শূন্যপদের সংখ্যা ১৭১টি। প্রথম শ্রেণির ৪৩টি পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ৮টি পদ, দ্বিতীয় শ্রেণির ১২৪টি পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ৮২ জন। শূন্য রয়েছে ৪২টি পদ। তৃতীয় শ্রেণির ১৫১টি পদের মধ্যে শূন্য পদ রয়েছে ১১৩টি এবং চতুর্থ শ্রেণির ১৮টি পদের স্থলে ৮টি পদ শূন্য রয়েছে।
এর মধ্যে অতিরিক্ত কমিশনারের দু'টি পদের বিপরীতে একটি, যুগ্ম কমিশনারের দু'টি পদের স্থলে একটি, সহকারী কমিশনারের ৮টি পদের স্থলে ৫টি, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার ৩৮টি, উচ্চমান সহকারীর ২১টি পদের বিপরীতে সবকটি, গাড়িচালকের ১১টি পদের মধ্যে ১০টি এবং সিপাহীর ৮৯টি পদের বিপরীতে ৫৪টি পদ শূন্য রয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির পদে লোকবল চলছে যশোর ও খুলনা ভ্যাট অফিসের জনবল দিয়ে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, 'বেনাপাল দিয়ে দেশের বেশিরভাগ পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। যে কারণে কাস্টমের লোকবল কম হওয়া উচিত না। এদিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। কাস্টম ও বন্দরের উন্নয়ন হলে বছরে এখান থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ সম্ভব হবে।'
জানা গেছে, প্রতিবছর বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি ও ৮ হাজার কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয়। আমদানি পণ্য থেকে সরকারের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়ে থাকে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানি হয় ১২ লাখ ৮৮ হাজার ৯৩৮ মেট্রিক টন পণ্য। বিপরীতে রপ্তানি হয় ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৭৩৯ মেট্রিক টন পণ্য। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমদানি ১৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩২৯ মেট্রিক টন, রপ্তানি ৩ লাখ ২৫ হাজার ৩৮১ মেট্রিক টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি ১৯ লাখ ৮৮ হাজার ৩৫৯ মেট্রিক টন, বিপরীতে রপ্তানি ৩ লাখ ৫২ হাজার ৯৬৩ মেট্রিক টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি ২১ লাখ ৮১ হাজার ১২৩ মেট্রিক টন, বিপরীতে রপ্তানি ৪ লাখ এক হাজার ১১৭ মেট্রিক টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমদানি ২০ লাখ ৩৮ হাজার ৬৪ মেট্রিক টন, বিপরীতে রপ্তানি ৩ লাখ ১৬ হাজার ৯৫০ মেট্রিক টন।
২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) আমদানি হয়েছে ১৭ লাখ ৫ হাজার ১১৩ মেট্রিক টন, বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৯৫ মেট্রিক টন পণ্য।
বেনাপোল বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া পণ্যের মধ্যে রয়েছে- শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত কাঁচামাল, তৈরি পোশাক, কেমিক্যাল, মেশিনারি যন্ত্রাংশ, সুতা ও বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য। আর রপ্তানি পণ্যের মধ্যে- পাট ও পাটজাত পণ্য, মাছ, মেলামিন, তৈরি পোশাক ও বসুন্ধরা টিস্যু উল্লেখযোগ্য।
ভারত-বাংলাদেশ ল্যান্ডপোর্ট ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কমিটির চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান জানান, 'দেশের স্থলপথে আমদানি-রপ্তানির ৭০ শতাংশ হয় বেনাপোল দিয়ে। এখানে লোকবল শূন্য থাকা উচিত না। এতে অন্য জনবলের উপর বেশি চাপ পড়ে। কাস্টমের লোকবল পূরণ এবং বন্দরের সক্ষমতা বাড়লে বেনাপোল দিয়ে সরকারের রাজস্ব দ্বিগুণ আদায় হতো'।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান জানান, 'কাস্টমের জনবল কম থাকায় স্বাভাবিকভাবে কাজের গতি কমে যায়। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হন। আবার যারা কর্মরত আছেন তাদেরকে বাড়তি কাজের চাপ নিতে হচ্ছে। এজন্য সরকারকে দ্রুত বেনাপোল কাস্টমে লোকবল নিয়োগ দিতে হবে। তাহলে ব্যবসায়ীদের জন্য কাজের সুবিধা বাড়বে'।
এ ব্যাপারে বেনাপোল কাস্টম হাউজের কমিশনার মো: আজিজুর রহমান জানান, 'করোনাকালে নিয়োগ সম্পন্ন করা যাচ্ছেনা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নিয়োগ হবে। আর লোকবল তেমন সংকট নেই। কেননা সব কাজ করে থাকেন রাজস্ব কর্মকর্তারা। সেখানে কোন ঘাটতি নেই'।
অন্য স্থলবন্দরের লোকবল
অন্য বন্দরগুলোর মধ্যে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে কোনো আমদানি হয় না, তাই লোকবলের তেমন ঘাটতি নেই। হিলি বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি দুটোই হয়।
হিলি স্থলবন্দরটি ২০০৫ সালের ৯ অক্টোবর স্থলবন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনার জন্য বেসরকারী পোর্ট অপারেটর পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেডকে দেয়া হয়। সেই অনুযায়ী বেসরকারী অপারেটর ২০১০ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে ব্যবসা পরিচালনা শুরু করে।
হিলি পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেড সূত্রে জানাচ্ছে, এই স্থলবন্দরের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী পদ রয়েছে ১০৭টি। এর মধ্যে বর্তমানে জনবল রয়েছে ১৪২ জন। আর কার্ডভুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা ৫০০ জন। স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের বা সরকারী কর্মকর্তা রয়েছেন ২ জন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, 'এখানে যে পরিমাণ জনবল প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি জনবল রয়েছে। সেক্ষেত্রে পণ্য আমদানী-রপ্তানী কিংবা লোড-আনলোডে কোন ধরনের সমস্যার মুখে পড়তে হয় না'।
হিলি ছাড়াও দিনাজপুরের আরেকটি স্থলবন্দর রয়েছে বিরল। এই স্থলবন্দরটি এখনও চালু হয়নি। সবেমাত্র স্থলবন্দরটির অবকাঠামো নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এই বন্দরটিও বেসরকারীভাবে পরিচালনার জন্য বিরল ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডকে দিয়েছে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ।
সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দরেও কোনো জনবল সংকট নেই। সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দরে মোট পদ রয়েছে ১০টি। এরমধ্যে কর্মরত আছেন ৮ জন। ওয়্যার হাউস সুপারিনটেন্ডেন্ট ও অফিস সহকারি এই পদ দুটি দীর্ঘদিন ধরে শূন্য আছে। ১০ পদের মধ্যে প্রথম শ্রেণির মাত্র একটি। ৭টি ৩য় শ্রেণির ও ২টি ৪র্থ শ্রেণির পদ। এই বন্দরে ২য় শ্রেণির কোনো পদ নেই।
তামাবিল স্থলবন্দরের সহকারি পরিচালক রুহুল আমিন জানান, 'এই বন্দরের কার্যক্রমে বৈচিত্র কম। মূলত ভারত থেকে পাথর ছাড়া এই বন্দর দিয়ে তেমন কিছু আমদানি হয় না। রপ্তানি কার্যক্রমও সীমিত। ফলে এখানে বেশি লোকবল প্রয়োজন হয় না। যে দুটি পদ খালি আছে এগুলোতে নিয়োগ হলে এইমুহুর্তে আমাদের কাজে গতি আরও বাড়ত। কিন্তু এই দুটি পদ অনেক দিন ধরে শূন্য'।
তিনি বলেন, 'বন্দর দিয়ে আমদানি রপ্তানিতে বৈচিত্র বাড়লে তখন আরও লোকবল লাগবে। এই অর্গানোগ্রাম দিয়ে হবে না'।