ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থির, প্রশাসনের তদারকির আগেই অতিরিক্ত মুনাফা লুটছে ব্যবসায়ীরা
প্রতিবছর রমজানের শুরুর দিকে হু হু করে বেড়ে যায় নিত্য প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যের দাম। অস্বাভাবিক দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওই সময় তৎপরতা বাড়িয়ে দেয় সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। এতে প্রশাসনের চাপে বেশি সুবিধা করতে পারে না মুনাফলোভী ব্যবসায়ীরা। ফলে নতুন কৌশল হিসেবে রমজানের বহু আগেই নিত্য প্রয়োজনীয় এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভোগ্যপণ্যের দেশের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে রমজানে প্রয়োজনীয় বেশির ভাগ ভোগপণ্যের দাম এখন উর্ধ্বমুখী। প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভোজ্যতেল, চিনি ও ডাল জাতীয় পণ্য ছোলা, মটর, মসুর, খেসারি ডালের দাম।
বর্তমানে খাতুনগঞ্জে পাইকারি পর্যায়ে মানভেদে প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) অস্ট্রেলিয়ার ছোলা বিক্রি হচ্ছে ২২০০-২৫৫০ টাকার মধ্যে। গত এক মাস আগেও একই মানের ছোলা ২২০০ টাকার নিচে বিক্রি হয়েছে। সেই হিসেবে, একমাসের ব্যবধানে প্রতি মণ ছোলার দাম বেড়েছে ৩৫০ টাক। এতদিন না থাকলেও আসন্ন রমজানকে ঘিরে মায়ানমারের ছোলাও ইতোমধ্যে বাজারে প্রবেশ করেছে, যা মণপ্রতি ২৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
স্বাভাবিক সময়ে বাজারে প্রতি মণ মটর বিক্রি হয় ১০০০-১১০০ টাকার মধ্যে (কেজি ২৭-৩০ টাকা)। কিন্তু গত এক মাসের মধ্যে দফায় দফায় বেড়ে বর্তমানে মটর বিক্রি হচ্ছে ১৪০০-১৪৫০ টাকার মধ্যে (কেজি ৩৮-৩৯ টাকা)। বাজারদর অনুযায়ী, গত এক মাসে দফায় দফায় পণ্যটির ৪৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
গত এক মাসে মণে প্রায় ৪০০ টাকা বেড়েছে আমদানিকৃত মসুরের দাম। বর্তমানে বাজারে প্রতি মণ কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার (মোটা জাতের) মসুর বিক্রি হচ্ছে ২৪২৫ টাকা (কেজি ৬৫ টাকা) দামে। যা একমাস আগে মাত্র ২০৫০ টাকার (কেজি ৫৫ টাকা) নিচে বিক্রি হয়েছে।
সম্পূর্ণ দেশীয় উৎপাদনে দেশের খেসারি ডালের চাহিদা মেটানো হয়। কিন্তু আমদানি না হলেও আমদানি পণ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে অস্বাভাবিক বেড়েছে খেসারি ডালের দাম। মাত্র এক মাস আগেও বাজারে প্রতিমণ খেসারি ডাল বিক্রি হয়েছে ২০৫০ টাকার (কেজি ৫৫ টাকা) নিচে। একমাসে প্রায় ৭৫০ টাকা বেড়ে বর্তমানে খেসারি ডাল বিক্রি হচ্ছে ২৮০০ টাকা (কেজি ৭৫ টাকা) দামে।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে অস্থির রয়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় আরেক ভোগ্যপণ্য চিনির বাজার। গত এক-দেড় মাস আগে বাজারে থাকা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতি মণ চিনি বিক্রি হতো ২১০০ টাকার নিচে। এই সময়ের মধ্যে ২৫০ টাকার বেশি বৃদ্ধি পেয়ে এখন প্রতি মণ চিনি বিক্রি হচ্ছে ২৩৫০-২৩৬০ টাকায়।
দীর্ঘদিন ধরে উর্ধ্বমুখী থাকলেও আসন্ন রমজানকে ঘিরে আরো অস্থির হয়ে উঠেছে সব ধরনের ভোজ্যতেলের বাজার। এরমধ্যে দফায় দফায় বেড়ে বর্তমানে পাইকারিতে প্রতিমণ (৪০ দশমিক ৯০ লিটার) পাম অয়েলের দাম ঠেকেছে ৩৮৫০-৩৯০০ টাকায়। যা একমাস আগেও ৩৪০০ টাকার নিচে বিক্রি হয়েছে।
একইভাবে দফায় দফায় বেড়ে বর্তমানে প্রতি মণ পাম সুপার অয়েল বিক্রি হচ্ছে ৪২০০ টাকায়। যা গত মাসেও ৩৮০০ টাকার নিচে বিক্রি হয়েছে। তাছাড়া গতমাসে প্রতি মণ সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৪১০০ টাকার মধ্যে। বর্তমানে একই সয়াবিন ৪৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারদর অনুযায়ী, গত এক মাসে প্রতি মণ ভোজ্যতেলের দাম ৩০০-৪০০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে খাতুনগঞ্জের একাধিক পাইকারি ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, অতীতে শবে বরাতের আগ মুহুর্ত থেকেই রমজানের ভোগ্যপণ্য বিকিকিনি শুরু হত। এরমধ্যে কোন পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বাড়লে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নজরদারি ও তদারকিতে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এবারে প্রশাসনের নজরদারি এড়াতে রমজানের প্রায় দুই মাস আগেই ভোগ্যপণ্যের বিকিকিনি শুরু করেছে আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। এতে গত একমাস থেকে রমজানে প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যের দাম আগের চেয়ে বেড়ে গেছে এবং এখনো সব পণ্যের দাম উর্ধ্বমুখী। এভাবে রমজানের দুই মাস আগে থেকে ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি করা অতি মুনাফালোভী আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের একটি কৌশল বলে উল্লেখ করেন অভিযোগকারী ব্যবসায়ীরা।
খাতুনগঞ্জ থেকে পাইকারিতে ভোগ্যপণ্য ক্রেতা ও খাদ্য পক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান 'স্টার লাইন গ্রুপের' পরিচালক মো. মাঈন উদ্দিন বলেন, গত একমাসে খাতুনগঞ্জের পাইকারিতে রমজানকেন্দ্রিক প্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি পণ্যের দাম উল্লেখ করে বলেন-, 'গত মাসে আমরা খাতুনগঞ্জ থেকে পাইকারি পর্যায়ে প্রতিকেজি চিনি ৫৮ টাকা, মটর ৩০-৩২ টাকা এবং ৯২ টাকায় প্রতি লিটার পাম অয়েল কিনেছি। কিন্তু চলতি সপ্তাহে একই চিনি ৬৫ টাকা, মটর ৩৮-৩৯ টাকা এবং পাম অয়েল ১০৬-১০৮ টাকায় কিনতে হয়েছে'। রমজান ঘনিয়ে আসার আগেই খাতুনগঞ্জসহ দেশের বড় বড় আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে অতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন এই ব্যবসায়ী।
চট্টগ্রাম ডাল মিল মালিক সমিতির সভাপতি পরিতোষ মহাজন বলেন, 'মহামারী করোনার কারণে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে ডাল জাতীয় পণ্যের ফলন ব্যাহত হয়েছে। এছাড়া করোনার শুরু থেকে আমদানি-রপ্তানির চেইন ভেঙ্গে পড়ায় প্রায় এক বছর ধরে বাজারে বেশিরভাগ পণ্যের দাম উর্ধ্বমুখী। আর্ন্তজাতিক বাজারের বুকিং দর বৃদ্ধি ও আসন্ন রমজানকে ঘিরে আমদানিকারক ও পাইকারী পর্যায়ে পণ্যের বিকিকিনি শুরু হওয়া গত একমাস ধরে প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর দাম আবারো কিছুটা বাড়তে শুরু করেছে'।
তবে রমজান ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে আমদানি ও চাহিদা বৃদ্ধি পেলে বাজারে পণ্যের দাম কিছুটা কমে আসবে বলে মন্তব্য করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, 'প্রতিবছর রমজানের আগেই নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির একটা প্রবণতা থাকে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। তবে গত এক বছর ধরে আর্ন্তজাতিক বাজারে প্রায় ভোগ্যপণ্যের দাম আগের চেয়ে কিছুটা বেশি। এরপরও আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের প্রতি আমাদের আহবান- যাতে পণ্যের আমদানি খরচ ও লাভের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পণ্য বিকিকিনি করে। অর্থাৎ কোন পণ্যের অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধি করে যাতে বাজারকে অস্থির করে না তুলে'।