ভোমরা স্থলবন্দর ছাড়ছেন আমদানিকারকরা, কমছে রাজস্ব আদায়
পণ্য খালাসে গড়িমসিসহ নানা অভিযোগ করে ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের অভিযোগ, বেনাপোলসহ অন্যান্য স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি করলে যে শুল্ক ছাড় পাওয়া যায়, ভোমরা স্থলবন্দরে তা পাওয়া যায় না। এছাড়া বন্দরে কর্মরত কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা হয়রানির অভিযোগ। ফলে ব্যবসায়ীরা এ বন্দর ছেড়ে বেনাপোলসহ অন্যান্য বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি করছেন।
ভোমরা বন্দর দিয়ে ২২ ধরণের পণ্য নিয়মিত আমদানি করা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় ফল। আমদানি কমে যাওয়ায় বন্দরটিতে রাজস্ব সংগ্রহও কমেছে। যা বন্দরটির বাৎসরিক লক্ষমাত্রা পূরণের উপর প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা ব্যবসায়ীদের। এ বন্দর দিয়ে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের প্রথম চার মাসের তুলনায় চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ফল আমদানি কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ।
ভোমরা স্থলবন্দর রাজস্ব শাখার তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বন্দর দিয়ে বিভিন্ন প্রকার ফল আমদানি হয়েছে ৩২ হাজার ১৩৩ দশমিক ৪৩৪ টন। এর মধ্যে জুলাই মাসে ৩ হাজার ২৯৫ টন, আগস্টে ৮ হাজার ৩৯১, সেপ্টেম্বরে ১০ হাজার ৮৮২ ও অক্টোবরে ৯ হাজার ৫৬৫ দশমিক ৪৩৪ টন।
অন্যদিকে, গত অর্থবছরে একই সময়ে এ বন্দর দিয়ে ফল আমদানি হয়েছিল ৪৫ হাজার ৭৯৩ টন। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ১৩ হাজার ৬৫৯ দশমিক ৫৬৬ টন বেশি।
গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ফল আমদানিতে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১৫১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। সেখানে চলতি অর্থবছরের গত চার মাসে ফল আমদানিতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১০৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় ফল আমদানি থেকে রাজস্ব আয় কমেছে ৪৪ কোটি টাকা।
ভোমরা সিএন্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের অর্থ সম্পাদক এএসএম মাকসুদ খান জানান, ভোমরা বন্দর দিয়ে ৭২ ধরনের পণ্য আমদানির অনুমোদন থাকলেও নিয়মিত পণ্য আমদানি হয় ২২ টি। নিয়মিত আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে রয়েছে আপেল, আনার, টমেটো, আঙ্গুর (সাদা), আঙ্গুর (কালো), শুকনা মরিচ, হলুদ, সিরামিক সামগ্রী (টাইলস তৈরীর কাঁচামাল), শুটকি মাছ, আদা, তেতুল, শুকনা কুল, পাথর, খৈল, রসুন, কাঁচা মরিচ, জিরা, পেয়াজ (বর্তমানে আমদানি হচ্ছে না), চাউল।
বাকি পণ্যগুলো অনিয়মিত ও খুব বেশি আমদানি করেন না ব্যবসায়ীরা।
বন্দরের ব্যবসায়ীদের সংগঠন সিএন্ডএফ’র এজেন্ট ফারহাদ ইন্টারন্যাশনালের মালিক ওহিদুল ইসলাম জানান, আগে এই বন্দর দিয়ে প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০টি করে ফলের ট্রাক বাংলাদেশে আসত। কিন্তু বর্তমানে আসছে ২০-২২টি।
ভোমরা বন্দর ছেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ী ওহিদুল ইসলাম বলেন, "ভোমরা স্থল বন্দর দিয়ে যে পরিমাণ রাজস্ব সংগ্রহ হয় তার বেশির ভাগই আসে ফল থেকে। সরকারকে এত পরিমাণ রাজস্ব দিয়ে ভারত থেকে ভোমরা বন্দরে পণ্য আসার পর বন্দর কর্তৃপক্ষ সেগুলোকে খালাস করতে গড়িমসি করে।
খালাস করতে দেরি হওয়ায় কাঁচামালগুলো ট্রাকে পচতে শুরু করে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যবসায়ীরা। এছাড়া কাস্টমস সুপার বিকাশ চন্দ্র দেবনাথ ব্যক্তি বিশেষের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আমদানিতে বিশেষ সুযোগ প্রদান করেন। যার কারণে অন্য ব্যবসায়ীরা ভোমরা বন্দর ছাড়ছেন।”
বন্দরের ব্যবসায়ী রুমা ইন্টারন্যাশনালের মালিক তরিকুল ইসলাম বলেন, "বন্দরে কাস্টমস সুপার বিকাশ চন্দ দেবনাথের নিজস্ব কিছু লোকজন আছে। শুকনা মরিচের প্রতি ট্রাকে তিনি ৯ হাজার টাকা উৎকোচ নিয়ে থাকেন। ঘুষের এ টাকা না দিলে গাড়ি দেশে প্রবেশ করতে পারে না। এসব টাকা তিনি তার লোকজনের মাধ্যমে উত্তোলন করেন। এতেও ক্ষিপ্ত ব্যবসায়ীরা।”
ভোমরা বন্দরের ব্যবসায়ী রহিমা ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক রাশেদুজ্জামান সোহাগ বলেন, "গত আগষ্ট মাসে দুই ট্রাক আপেল খালাসে কাস্টমস অফিসের গড়িমসির কারণে আমার ক্ষতি হয়েছে সাড়ে তিন লাখ টাকা। সব আপেল পচে যাওয়ায় এ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি আমি।”
চলতি ২০১৯-২০ আর্থিক বৎসরে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত ভোমরা বন্দর দিয়ে কোনও চাল আমদানি করেন নি ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে, ২০১৮-১৯ আর্থিক বৎসরে শেষ চার মাসের ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত ভোমরা বন্দর দিয়ে চাল আমদানি হয়েছিল ৬ হাজার ৯৩৩.৫ মেট্রিক টন। যার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৫ কোটি ৩৮ লাখ ৪০ হাজার ৮৩২ টাকা।
ভোমরা স্থলবন্দর সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান নাসিম বলেন, অন্যান্য বন্দরে ফল আমদানিতে ব্যবসায়ীরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পায়, ভোমরা বন্দরে তা নেই। অন্য বন্দরে প্রতি ট্রাক ডালিম আমদানি করলে কার্টন বা বাক্সের মূল ওজন বাদ দিয়ে ওজন করা হয়। এছাড়া প্রতি ১০ টনের ট্রাকে দুই টন পর্যন্ত ওজনের বিপরীতে শুল্ক ছাড় দেয়া হয়। আপেল ও কমলা আমদানিতেও সমপরিমাণ ছাড় সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু ভোমরা বন্দরে কোনও ছাড় দেওয়া হয় না। এতে আমদানি খরচ বেশি পড়ে ব্যবসায়ীদের। এ কারণেও ফল আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা ভোমরা বন্দর ত্যাগ করছেন।”
ভোমরা স্থল বন্দরের কাস্টমস সুপার বিকাশ চন্দ্র দেবনাথ তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘অভিযোগগুলো সঠিক নয়। আমি কোনও অনৈতিক সুবিধা নিই না। এছাড়া ব্যবসায়ীদেরও কোনো হয়রানি করি না। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ দিলে আমি কি করবো। কোনো ব্যবসায়ী ভোমরা বন্দর ছেড়ে অন্য বন্দরে গেলে আমাদের কিছু করার থাকে না।’’
তিনি আরও বলেন, পণ্য চাহিদার উপর আমদানি কম-বেশি হয়। ব্যবসায়ীরা যে পরিমাণ এলসি করবেন, তার বিপরীতে পণ্য আমদানি হয়। সম্প্রতি ফল আমদানি কিছুটা কমেছে। আগামীতে বাড়তেও পারে। সেই সঙ্গে রাজস্ব আদায়ও বাড়বে।