মহামারির মাঝেও ফুলেফেঁপে উঠেছে বিস্কুটের চাহিদা
করোনা মহামারি দেশের প্রায় সব ব্যবসাকে অন্ধকারে ঠেলে দিলেও সুসময় দেখছে বিস্কুট ও ব্রেড শিল্প। করোনার সময়েও ব্যবসায় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি প্রবৃদ্ধি পেয়েছে এখাতের কোম্পানিগুলো। চাহিদা অনেক বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে বিনিয়োগ করছে দেশের শীর্ষ দুই প্রতিষ্ঠান অলিম্পিক, প্রাণসহ অনেক প্রতিষ্ঠান।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাস্তার খোলা খাবার অনিরাপদ হওয়ায় করোনার সময়ে মানুষ প্যাকেটজাত বিস্কুট ও ফাস্টফুডে ঝুঁকেছে। এপ্রিল থেকে অক্টোবর সময়ে ২০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি পেয়েছে অধিকাংশ কোম্পানি। বিদেশে বিস্কুট রপ্তানিতেও ৫০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি পেয়েছে দেশের বাজারে নেতৃত্বদানকারী অলিম্পিক। যদিও সাধারণ সময়ে দেশের বাজারে এখাতের প্রবৃদ্ধি ১০-১২ শতাংশের বেশি হয় না।
দেশের বিস্কুটের বাজারে প্রায় ২৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করা অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রি এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ২২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে দেয়া মূল্য সংবেদনশীল তথ্যানুযায়ী, বাজার চাহিদার প্রেক্ষিতে কোম্পানিটি উৎপাদন বাড়াতে নতুন মেশিন স্থাপনে ৪২ কোটি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন সেটআপ শেষ হওয়ার পর কোম্পানিটি বার্ষিক প্রায় ১২ হাজার ৪৪২ টন বিস্কুট উত্পাদন করতে সক্ষম হবে। বিস্কুট এবং বেকারি আইটেমের মোট উত্পাদন ক্ষমতা বার্ষিক ১ লাখ ২৯ হাজার ৬৫৬ টনে উন্নীত হবে।
অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রির নির্বাহী পরিচালক মো. নাজিমুদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ অনেক স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছে। তাই সাধারণ মানুষ বাইরের খোলা খাবারের চেয়ে প্যাকেটজাত বিস্কুট এবং কনফেকশনারি আইটেম বেশি নিচ্ছে। এজন্য আমরা উন্নতমানের বিস্কুট উৎপাদন বাড়াতে নতুন বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'
খুব শিগগিরিই নতুন মেশিন স্থাপন করে বিস্কুটের উ'পাদন বাড়ানো হবে বলেও তিনি জানান।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই প্রথমবারের মতো, ২০১৯-২০ অর্থবছরে কোম্পানিটি দেড় হাজার কোটি টাকার সেলস মার্ক অর্জন করেছে।
মহামারির সংক্রমণ ঠেকাতে দেশজুড়ে দেওয়া লকডাউনের পরবর্তী সময়েও কোম্পানিটি নিজেদের উৎপাদন এবং বিক্রির গতি ধরে রেখেছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকেও বিস্কুট বিক্রিতে ১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখেছে। এর রপ্তানি বিক্রয় এপ্রিল-জুন সময়কালে ৫১ শতাংশ বেড়েছে, যা লকডাউনের পরেও বজায় ছিল।
করোনার সময়ে ১৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি পেয়েছে বাজার অংশীদারিত্বে দ্বিতীয় স্থানে থাকা প্রাণ আরএফএল গ্রুপ। বাজারের নতুন চাহিদা মেটাতে কোম্পানিটির সম্প্রসারণকৃত নতুন প্রোডাক্টশন লাইনে দুই মাস পরেই বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে।
প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপক (মার্কেটিং) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, 'বাজারের চাহিদা মেটাতে প্রাণের কারখানা সম্প্রসারণের কাজ চলছে। দুই মাসের মধ্যে নতুন লাইনে উৎপাদন শুরু হতে পারে। উৎপাদন ব্যবস্থাটি যুক্ত হলে বর্তমান সক্ষমতার সঙ্গে আরো ৩০ শতাংশ যুক্ত হবে।'
২০১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিস্কুটের মার্কেটে যোগ দেয় প্রাণ। যোগ দিয়েই তারা বিভিন্ন রকমের বিস্কুট উৎপাদন শুরু করে। বিভিন্ন দোকানে বিক্রির পাশাপাশি নিজেদের আউটলেট 'মিঠাই' এর মাধ্যমেও কোম্পানিটি তাদের পণ্য বিক্রি করে আসছে।
বাংলাদেশে বিস্কুট উৎপাদনে পুরানো প্রতিষ্ঠিত ব্র্যন্ডের অন্যতম নাবিস্কো। ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটি বর্তমানে ২৬টি ভিন্ন ব্র্যান্ডের বিস্কুট উৎপাদন করে। করোনার সময়ে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি পেয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটিও। তবে বর্তমান সক্ষমতা ব্যবহার করেই বাজার ধরে রাখতে আগ্রহী তারা।
নাবিস্কো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ফ্যাক্টরির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার এস এম মাহমুদ আলম বলেন, 'বাজারে বিস্কুটের চাহিদা অনেক। প্রতিনিয়তই বাজার সম্প্রসারণের প্রয়োজন অনুভব করছি। তবে বর্তমান সক্ষমতার মধ্যে থেকেই ব্যবসা পরিচালনায় আগ্রহী পরিচালকগণ। ফলে এই মূর্হুতে নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা আমাদের কাছে নেই।'
নাবিস্কো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ফ্যাক্টরি লিমিটেড এবং প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ উভয়ই বাজারের ৮ শতাংশ শেয়ার নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।
বাংলাদেশ অটো-বিস্কিটস অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএবিবিএমএ) সূত্র মতে, দেশের বিস্কুট ও কনফেকশনারি পণ্যের বাজারের আকার এখন প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
হক, আল-আমিন এবং ড্যানিশ এই বাজারের পাঁচ শতাংশ করে নিয়ন্ত্রণ করে। এর পরে বঙ্গোজ, রোমানিয়া, ডেকো, গ্লোব, ফু-ওয়াং, বনোফুল, কিশোয়ান, থাই ফুড, বেঙ্গল, গোল্ড মার্ক, মাশফি এবং নিউ অলিম্পিয়া রয়েছে, বাজারে এদের প্রত্যকের অংশীদারিত্ব ২-৩ শতাংশ।
কোকোলা, চিনা, কাকোলি, শিফা এবং কোহিনূর শিল্পসহ অন্যান্য সংস্থাগুলিও বাজারের একটি বড় অংশ দখল করেছে।
করোনার সময়ে এসব ব্র্যান্ডের পাশাপাশি বিক্রি বেড়েছে ছোট ছোট ব্র্যান্ড ও অটো বিস্কুট উৎপাদকদেরও।
বাংলাদেশ অটো বিস্কুট ও ব্রেড প্রস্তুতকারক ম্যানুফ্যাকচারার্স- এর সভাপতি মোঃ শফিকুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, বড় ব্র্যান্ডের পাশাপাশি ছোট ছোট কোম্পানিগুলোও এ সময়ে বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া, দেশের বড় দুই গ্রুপ কোহিনুর কেমিক্যালের রিডিশা ব্র্যান্ড সম্প্রতি বাজারে এসেছে। বসুন্ধরা গ্রুপের বিনিয়োগও পাইপ লাইনে রয়েছে।