মাংস ও ডিমের দাম বাড়তি, তবু লোকসানে খামারি
ফরিদপুরের খামারি আল-মামুন একটি ব্যাচে ১ হাজার ব্রয়লার মুরগি পালন করেন। এই মুরগিগুলোর লাইভ ওয়েট দুই কেজিতে নিতে খাবার, মেডিসিন, কর্মচারীর বেতনসহ হিসেব করলে খরচ পড়ে ২ লাখ ৪২ হাজার টাকা। কিছু মুরগির কম ওজন, মরে যাওয়া-সহ গড়ে হিসেব করলে নির্ধারিত সময় শেষে ১৮০০ কেজি মুরগি পাওয়া যায়।
বর্তমান বাজার দর হিসেবে ১৩০ টাকা কেজি দরে মুরগি বিক্রি করলে দাম আসে ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ এই একটি ব্যাচের মুরগি বিক্রির পর এই খামারির লোকসান দাঁড়াচ্ছে ৮ হাজার টাকা।
শনিবার ঢাকায় ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প ফোরাম আয়োজিত 'প্রান্তিক খামারি সভায়' এভাবেই খামারিরা নিজেদের চিত্র তুলে ধরেন। যেখানে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ১৫ জনের বেশি খামারি তাদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেন।
তারা দাবি করেন, দেশে ব্রয়লার মুরগির মাংস ও ডিমের দাম হু হু করে বাড়লেও প্রতিনিয়তই প্রান্তিক খামারিরা লোকসান গুনছেন। মুরগির বাচ্চা ও ফিডের দাম বাড়লেও খামারি পর্যায়ে উৎপাদিত মাংস ও ডিমের দাম বাড়েনি বলেই এই লোকসান গুনতে হচ্ছে।
ঢাকার বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির মাংস ১৭০-১৮০ টাকা এবং প্রতি ডজন ডিম ১১০-১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, এক মাসের ব্যবধানে খুচরা বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ।
মুন্সিগঞ্জের খামারি মো. আলমগীর জানান, তিন মাস আগেও এক বস্তা (৫০ কেজি) মুরগির খাবার ২২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা এখন কিনতে হচ্ছে ২৭৫০ টাকায়। সপ্তাহখানেকের মধ্যে আরও ১০০ টাকা দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন খাদ্য প্রস্তুতকারীরা। অন্যদিকে, একদিনের বাচ্চার দাম ১০ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ টাকায়।
রাজবাড়ির খামারি মানিক শেখ বলেন, 'খামার এখন উদ্যোক্তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উৎপাদন করছি আমরা, লাভ গুনছে সিন্ডিকেটের লোকজন।'
ফিডের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে প্রাণি খাদ্য প্রস্তুতকারীদের সংগঠন জানিয়েছে, এক বছরের ব্যবধানে সয়াবিন মিলের দাম ৪১.১৮ শতাংশ, ভুট্টার দাম ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এ কারণে তারা খাদ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন, যেখানে খাদ্য তৈরিতে ৫০-৫৫ শতাংশ ভুট্টা এবং ২৫-৩০ শতাংশ সয়াবিন মিল ব্যবহার হয়।
ফিড ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসেসিয়েশন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মো. আহসানুজ্জামান দাবি করেন, স্থানীয় ভোজ্যতেল প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত সয়াবিন মিল দিয়ে দেশের ফিড ইন্ডাস্ট্রির ৭০-৭৫ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয়। এর মধ্যে সরকার সয়াবিন মিল ভারতে রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। রপ্তানির অনুমতি পাওয়ার পর থেকেই স্থানীয় উৎপাদনকারীরা সিন্ডিকেট করে কাঁচামালটির দাম আরও বাড়িয়ে তুলছেন।
এদিকে খামারিদের দাবি, কাঁচামালের দাম বাড়ছে, তাদের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। কিন্তু মাংস ও ডিম কত টাকায় বিক্রি হবে সেটা খামারিদের হাতে নেই। যারা ট্রেডার রয়েছেন, তারা এই কাজটা করছেন। ফলে মাংস বিক্রি করে তাদের খরচেই উঠাতে পারছেন না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরেক খামারি কাওসার আহমেদ বলেন, 'লোকসান করতে করতে আমরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। দামটাও আমরা নির্ধারণ করতে পারছি না। নির্ধারণ করছে অন্য একটি সিন্ডিকেট, যারা আমাদের পণ্য নিয়ে বাজারে সাপ্লাই দিচ্ছে।'
একইসঙ্গে সিন্ডিকেট করে মুরগির বাচ্চা ও খাদ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে দাবি করেন খামারিরা।
তারা জানান, করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনের সময়ে চাহিদা কম থাকায় এমনিতেই মুরগি ও ডিম বিক্রি করতে হয়েছে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে। এতে প্রান্তিক খামারিরা লোকসান গুনতে গুনতে দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে এখন ফিড ও বাচ্চার যে দাম, সেটা দিয়ে খামার পরিচালনা করতেই হিমশিম খাচ্ছেন।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প ফোরাম জানায়, সারা দেশে প্রান্তিক খামারির সংখ্যা ৬০ লাখ। তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত সোয়া কোটি লোকের কর্মসংস্থান জড়িত। এই সেক্টরের অবস্থা খারাপ হতে থাকলে এতগুলো পরিবার দুর্দশায় পড়বে, যা দেশের অর্থনীতিতে বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ কারণে দ্রুত একটি নীতিমালা করে খামারিদের সুরক্ষার দাবি জানানো হয়।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য বিজ্ঞানী ড. লতিফুল বারী খামারিদের নিজেদের খামারের প্রয়োজনীয় খাবার নিজেদের প্রস্তুত করার পরামর্শ দেন, যেন ফিড ইন্ডাস্ট্রির ওপর তাদের নির্ভর করতে না হয়।
তিনি বলেন, 'খামারিরা মুরগির খাবার তৈরি করতে পারেন, এমন প্রযুক্তি আমাদের কাছে আছে। এর জন্য প্রতিক্ষণ দরকার। এটা করতে পারলে খাবারের খরচ অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।'
এ সময় বাংলাদেশ এসএমই ফোরামের প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা চাষী মামুন বলেন, 'প্রতিটি জেলায় খামারিদের খাদ্য তৈরির বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে ফোরাম দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করবে। একইসঙ্গে প্রান্তিক খামারিদের রক্ষার জন্য সরকারের কাছে একটি নীতিমালার জোর দাবি করছি।'
অনুষ্ঠানে খামারিরা ফিড ও বাচ্চার অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধি বন্ধ, খামারিদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নির্ধারণে সুযোগ, পোল্ট্রির কাঁচামালে ভ্যাট ট্যাক্স মওকুফ, সয়াবিন মিল রপ্তানি বন্ধ, সহজ শর্তে ঋণ বিতরণসহ সরকারের কাছে মোট ১১টি দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো পড়ে শোনান খামারি মাসুমা খানুম।