লকডাউনে অগ্রীম বুকিং হারিয়ে বিপাকে দেশের রিসোর্ট শিল্প
বিগত কয়েক মাসে দেশের হোটেল ও রিসোর্ট ব্যবসা নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। গত বছর দেশজুড়ে প্রথম লকডাউনের পর মানুষ এক রকম হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। মহামারির কারণে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশের অভ্যন্তরেই প্রকৃতের সান্নিধ্যে নির্মলতার সন্ধান লাভে রিসোর্টে ছুটে যান ভ্রমণপিপাসুরা। এ বছর মার্চের মাঝামাঝি অবধি রিসোর্টের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ অতিথিদের দ্বারা পূর্ণ থাকত। একঘেয়ে জীবনে ক্লান্ত নগরবাসী হাওয়া বদলের উদ্দেশ্যে রিসোর্ট কেন্দ্রিক ভ্রমণের পরিকল্পনা সাজাতেন।
তবে, সব পরিকল্পনাই এবার ভেস্তে গেছে। সপ্তাহব্যাপী লকডাউনে রিসোর্টগুলোতে এ মাসের অন্তত ২৫ শতাংশ অগ্রীম বুকিং বাতিল করা হয়েছে।
সরকার হোটেল এবং রিসোর্টগুলোর উপর সরাসরি কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করলেও প্রায় সব রিসোর্টই নতুন অতিথিদের অভ্যর্থনা জানানো থেকে বিরত আছে।
রিসোর্ট মালিকদের সংগঠন ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ড্রাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক সংখ্যক পর্যটকদের নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে।
গাজীপুরের জয়দেবপুরের ছুটি রিসোর্টের হেড অব সেলস আবুল হোসেইন আবির জানান, "আমাদের রিসোর্ট খোলা আছে। কিন্তু, লকডাউনের জন্য এখন কোনো অতিথি নেই। গড়ে আমাদের ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ কক্ষ অতিথিদের দিয়ে পরিপূর্ণ থাকলেও, সংক্রমণ বাড়ায় গত সপ্তাহে এই হার ১০ থেকে ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে।"
গত বছর ২৫ জুলাই রিসোর্টটি পুনরায় চালু হওয়ার পর পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেয়। কিন্তু, এখন সেখানে কোনো ছাড় নেই।
আবির জানান গত শীতের মৌসুমে তাদের রিসোর্টে অতিথিদের উপস্থিতি ছিল ধারণ ক্ষমতার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ।
লকডাউনে গাজীপুরের ভাওয়াল রাজবাড়ি এলাকার বিলাসবহুল সারাহ রিসোর্টও ফাঁকা পড়ে আছে।
রিসোর্টের ব্যবস্থাপক (জন সংযোগ) ইসমাইল হোসাইন বলেন, "মানুষ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে যেতে পারছেন না। এ কারণে গত কয়েক মাসে আমাদের প্রত্যাশিত তুলনায় অতিথি সংখ্যা বেশি ছিল, বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে।"
তিনি জানান, লকডাউনের পর অতিথিদের জন্য রিসোর্ট পুনরায় খুলে দেওয়া হবে।
গাজীপুরের প্রথম দিকের রিসোর্টগুলোর মধ্যে নক্ষত্রবাড়ি অন্যতম। বর্তমানে তারাও অতিথিদের গ্রহণ করছেন না।
সহকারী ব্যবস্থাপক মেহেদি হাসান জানান, "গড়ে ৫০ শতাংশ অতিথিসহ গত সপ্তাহে আমাদের ব্যবসা বেশ ভালো চলেছে। কিন্তু এ মাসের অধিকাংশ অগ্রীম বুকিং বাতিল করা হয়েছে।"
"আমি অপর এক রিসোর্টের কথা জানি যারা লকডাউনের কারণে প্রায় ৯০ লাখ টাকার বুকিং হারিয়েছে," বলেন তিনি।
করোনার শনাক্ত সংখ্যা বাড়তে থাকলেও রিসোর্টের অতিথি সংখ্যা কমেনি বলেও জানান মেহেদি হাসান। তবে, চলমান লকডাউনের কারণে রিসোর্টকে লোকসান গুণতে হচ্ছে।
রিসোর্টের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এখন পর্যন্ত ৫০ জনের অধিক কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
দেশের বিভিন্ন জেলার মধ্যে, গাজীপুরে রিসোর্টের সংখ্যা সর্বাধিক। জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, এখানে রেজিস্ট্রিকৃত ৭৬ টি রিসোর্ট ছাড়াও অসংখ্য রেজিস্ট্রিবিহীন রিসোর্ট আছে।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী দেশে ২০০ টির অধিক রিসোর্ট আছে। বিশেষত, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং নরসিংদীসহ ঢাকার আশেপাশের অঞ্চলে এসব রিসোর্ট গড়ে উঠেছে।
গত বছর ৩১ মে সাধারণ ছুটি শেষ হলে রিসোর্টগুলো খুলতে শুরু করে। রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের দাবী অনুযায়ী, তারা বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
সাধারণত বাংলাদেশের রিসোর্টগুলোতে দিনব্যাপী এবং রাত্রিযাপন দুই ধরনের প্যাকেজই পাওয়া যায়। তবে, কিছু রিসোর্ট মহামারির সময় ভিড় এড়াতে দিনের বেলায় অবকাশযাপন নিরুৎসাহিত করেছে।
শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত পূর্বাচলের লা রিভারিয়া রিসোর্টে সারাদিন কাটাতে হলে জনপ্রতি গুণতে হয় ২,৯০০ টাকা।
লা রিভারিয়া রিসোর্টের কাস্টমার এক্সিকিউটিভ সারা জানান, "গত কয়েক মাসে আমরা সারা দিন থাকার জন্য ৭০ থেকে ৮০ জন অতিথি পেয়ে আসছি। বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে ভিড় বাড়ে। আমাদের ১৩ টি কটেজ আছে, যেখানে ২৬ জন অতিথি রাত্রিযাপন করতে পারেন।"
লকডাউনের সময় রিসোর্টটি অতিথিদের থাকার অনুমতি দিচ্ছে না।
গত বছরের পয়লা জুন থেকে পুনরায় কার্যক্রম চালু করে নড়াইলের অরুণিমা রিসোর্ট গলফ ক্লাব। রিসোর্টে ৪০ টি কটেজ আছে। তবে, এ সপ্তাহের শুরু থেকেই কার্যক্রম স্থগিত আছে।
রিসোর্টের পরিচালক খবির উদ্দিন আহমেদ বলেন, "রিসোর্ট পুনরায় চালু করার পর গড়ে আমাদের অতিথির হার ছিল ধারণ ক্ষমতার ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। করোনার নতুন ঢেউ শুরু হওয়ার পর তা ৩০ শতাংশে এসে ঠেকেছে।"
ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ড্রাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি খবির উদ্দিন আরও জানান, "রিসোর্ট শিল্পে ভূমি ও অবকাঠামোসহ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। আমরা ব্যবসা বন্ধ রাখলে হাজার হাজার কর্মচারি চাকরি হারাবে।"
গত দশকে বাংলাদেশে রিসোর্ট শিল্প বিকাশ লাভ করে। বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবী এবং যুগলরা তাদের প্রধান অতিথি বলে জানান রিসোর্ট মালিকরা।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে রিসোর্ট শিল্পের বাজার প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সমমূল্য। এছাড়া, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের পাঁচ মানুষের জীবিকা রিসোর্ট খাত নির্ভর।
- সংবাদটি ইংরেজিতে পড়ুন: Resorts see advance booking cancellations amid lockdown