শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি: তাঁতশিল্প পুনরুজ্জীবিত করার মেগা প্রকল্প
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা ও মাদারীপুর জেলার শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি নির্মাণ করা হচ্ছে। ১ হাজার ৯১১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ কাজ করছে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড (বিএইচবি)। এ শিল্প গড়ে উঠলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
যেখানে তাঁতশিল্পের সাথে থাকবে তাঁতিদের আবাসন ব্যবস্থা। তাঁতিদের কর্মসংস্থান, দক্ষতা বৃদ্ধি, পণ্যের গুণগত মান উন্নয়ন, বাজারজাতকরণ, পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত, দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক বাজারে তাঁতবস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে তাঁতিদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়েই গড়ে উঠছে তাঁতশিল্প পল্লী।
পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে তাঁতপল্লি গড়ে তোলার পরিকল্পনা থেকে ১২০ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন করেছে প্রশাসন। শরীয়তপুর অংশে ৬০ একর এবং মাদারীপুর শিবচর অংশে ৬০ একর জমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে। ভূমি ভরাটের মাধ্যমে চলছে ভূমি উন্নয়ন কাজ। এরপর শুরু হবে অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ।
এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। প্রথম পর্যায়ের এই কাজের মেয়াদ ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত।
প্রকল্পে ৮ হাজার ৬৪টি তাঁত শেড নির্মাণ করা হবে। যেখানে ৮০৬৪ জন তাঁতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হবে। বছরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৪ দশমিক ৩১ কোটি মিটার কাপড়।
প্রকল্প পরিচালক জাহাঙ্গীর আলী খান টিবিএসকে বলেন, শেখ হাসিনা তাঁতপল্লির প্রথম পর্যায়ের কাজ চলমান আছে। প্রথম পর্যায় কাজে ভূমি অধিগ্রহণ কাজ শেষ হয়েছে। এখন ভূমি উন্নয়ন আর সীমানা প্রাচীর নির্মাণ কাজ চলছে। করোনার কারণে কাজ কিছুটা পিছিয়ে গেলেও নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যেই কাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন তিনি।
এ কাজ শেষে তাঁতপল্লি উন্নয়নের খসড়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মাস্টারপ্লান তৈরি করবে। সেই মাস্টারপ্ল্যান জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেকে) পাস হলেই দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হবে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি প্রকল্পের আওতায় কী কী হবে তার একটা খসড়া করা হয়েছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক। প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান খসড়ায় প্রয়োজনে নতুন কিছু যোগ করতে পারবে। এই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেই তৈরি হবে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লির মস্টারপ্ল্যান। একনেকে অনুমোদনের পর দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হবে।
জাহাঙ্গীর আলী খান বলেন, প্রকল্পটির আওতায় তাঁতিদের কাপড় বোনা থেকে শুরু করে সব ধরনের সুবিধা দেওয়া হবে। তাঁতিদের জন্য থাকবে আবাসিক ভবন, তাঁত শেড, ডরমেটরি, রেস্ট হাউস, সাইবার ক্যাফে ও বিদ্যুতের উপকেন্দ্র।
তাঁতপল্লিতেই সপ্তাহে দুই দিন তাঁতপণ্যের হাট বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে। সে হাটে সুতাসহ সবধরনের কাঁচামাল বিক্রয় ও প্রদর্শন করা হবে। তাঁতের কাপড় বোনা থেকে শুরু করে পোশাক তৈরি ও বিক্রি পর্যন্ত সব ব্যবস্থাই করা হবে প্রকল্পের আওতায়।
বিসিকের মাধ্যমে মূলত তাঁতিদের সংগঠিত করা হবে। দেশের যেসব স্থানে তাঁতিরা দুরবস্থার মধ্যে আছে তারা অগ্রাধিকার পাবেন। এছাড়া এই পল্লীতে বিলুপ্ত প্রায় বিভিন্ন তাঁতশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগও থাকবে।
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের আবিষ্কার থেকে জানা যায় যে, প্রাচীনকালে বাংলা সুতিবস্ত্র উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল। বাংলায় বস্ত্রশিল্পের সস্তা উপকরণ তুলা প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হতো। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে ঢাকার মসলিন এশিয়া ও ইউরোপে সুখ্যাতি ও বিপুল কদর লাভ করে।
তবে তাঁতিরা দৈনন্দিন ব্যবহারোপযোগী যেসব কাপড় প্রস্তুত করতেন সেগুলির অধিকাংশই হয় মোটা এবং অপেক্ষাকৃত কম দামি। তাঁতিদের কারখানায় এখন মানের দিক থেকে উৎকৃষ্ট বিবেচিত কাপড় প্রায় দুষ্প্রাপ্যই বলা চলে। তাঁতিরা এখন সাধারণ মানুষের আটপৌরে ব্যবহারের কাপড় তৈরি করেই তাদের পেশা জিইয়ে রেখেছেন।
আগেকার দিনে হস্তচালিত তাঁতের সাহায্যে তাঁতবস্ত্র তৈরি করার জন্য চরকা বা সুতাকাটার টাকু ব্যবহার করা হতো। আজকাল পর্যাপ্ত পরিমাণে সুতা মেশিনে তৈরি হচ্ছে, পরিণতিতে চরকা প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। এখন বয়নকারীরা শুধু নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যবহারোপযোগী চলতি মানের সস্তা গামছা, গেঞ্জি, লুঙ্গি এবং শাড়ি প্রস্তুত করছেন।
ভবিষ্যতে এখানে আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনায় তাঁতপল্লি নিয়ে এলাকায় স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যেও আগ্রহের সঞ্চার হয়েছে।
তাঁতপল্লি হবে জেনেই পাবনা থেকে ব্যবসার উদ্দেশ্যে এসে বসতি গড়েছেন বিল্লাহ হোসেন। প্রকল্পের পাশেই জমি কেনার চেষ্টা করছেন। তাঁতশিল্প এলাকা হলে এখানে নিশ্চিতভাবেই ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে বলে মনে করছেন তিনি। তার মতে, এখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিনিয়োগকারীরা আসবেন ও এলাকাটি একটি পুর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত হবে।
জেলা প্রশাসক পারভেজ হাসান টিবিএসকে বলেন, শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে টিকিয়ে রাখার প্রয়াস। এর ফলে উন্নত হবে দেশের তাঁতশিল্প। জীবন মান উন্নয়ন ঘটবে তাঁতিদের। ভাগ্যে পরিবর্তন ঘটবে তাঁতিদের। একই সঙ্গে সাথে এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন ঘটবে। স্থানীয় মানুষের জন্য সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান।