সহজ শর্তে সুতা আমদানি করতে চান তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারীরা
আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম বৃদ্ধির অজুহাতে স্থানীয় স্পিনিং মিল মালিকরা সুতার দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়েছে বলে অভিযোগ তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের। একই অভিযোগ টেরি টাওয়েল রপ্তানিকারকদেরও। এ পরিস্থিতিতে সুতা আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান কিছু বাধা অপসারণ করার পাশাপাশি বন্ড লাইসেন্সবিহীন রপ্তানিকারকদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় সুতা আমদানির অনুমতির দাবি জানিয়েছেন তারা।
ইস্যুটি নিয়ে তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং প্রতিযোগিতা কমিশনে চিঠি পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনেরও আয়োজন করেছে সংগঠনটি।
অবশ্য তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের এমন অভিযোগের সঙ্গে একমত নন টেক্সটাইল মিল মালিকরা। তারা বলছেন, এই সময়ে তারা অস্বাভাবিক মুনাফা করছেন না । চাহিদার তুলনায় সুতার কাঁচামাল তুলার সরবরাহ কম থাকায় সারা বিশ্বেই দাম বাড়তির দিকে। এ পরিস্থিতিতে সুতা আমদানি করলেও তা পোশাক শিল্প মালিকদের জন্য সুবিধাজনক হবে না।
দেশের রপ্তানি আয়ের ৮১ শতাংশের বেশি আসে তৈরি পোশাক থেকে, যার মূল কাঁচামাল তুলা আমদানি নির্ভর। এর বাইরে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি হোম টেক্সটাইলের মূল কাঁচামালও তুলা। স্থানীয় স্পিনিং মিলগুলো তুলা আমদানি করে উৎপাদিত সুতা বিক্রি করে নিটওয়্যার ও হোম টেক্সটাইল উৎপাদনকারীদের কাছে।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সম্প্রতিক সময়ে সুতার অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ব্যবসার জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে আমদানিকৃত সুতার চেয়ে স্থানীয় সুতার দাম প্রতি কেজিতে ২০ থেকে ৩০ সেন্টস বেশি থাকতো। এখন তা ১ ডলার পর্যন্ত বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।"
"এতদিন পর্যন্ত আমরা সুতা আমদানি করতে চাইনি। তবে, এখন ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে আমদানিতে মনোযোগী হতে হবে। এজন্য আমদানিতে যত ধরনের বাধা রয়েছে, তা অপসারণের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি লিখবো", জানান বিজিএমইএ সভাপতি।
একই ধরনের অভিযোগ করলেন বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফেকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ) চেয়ারম্যান এম শাহাদাত হোসাইন। নিজের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, "গত ১৭ জুলাইয়েও টাওয়েলে ব্যবহার হওয়া ২০ রিং স্পান সুতার দাম ছিলো গত ৩.৯০ ডলার। আর গতকাল (রোববার) এই সুতার দাম চাইছে ৪.৩০ ডলার। অথচ একই সুতা ভারতের বাজারে ৩.৪০ ডলার।"
"এখন আমরা চাই সুতা আমদানি উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক। যাতে বন্ড লাইসেন্স নেই, এমন রপ্তানিকারকদেরও শুল্কমুক্ত সুবিধা আমদানির অনুমতি দেওয়া হোক," বলেন তিনি।
এই দাবিতে ইতোমধ্যে সরকারের কাছে তার সংগঠনের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
দেশে বন্ড লাইসেন্সধারী রপ্তানিকারকরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় সুতা আমদানি করতে পারেন। কিন্তু নিটওয়্যার ও টেরি টাওয়েল রপ্তানিকারকদের প্রায় অর্ধেকেরই বন্ড লাইসেন্স নেই। সেক্ষেত্রে আমদানির ক্ষেত্রে তাদের বাড়তি ৩০ শতাংশ বা তারও বেশি শুল্ককর দিতে হয়।
আবার ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানির ক্ষেত্রে একই এলসির পণ্য একসঙ্গেই আনতে হবে, পার্শিয়াল আমদানির সুযোগ নেই। ফলে স্থলপথে আমদানি সুবিধাজনক হওয়া সত্ত্বেও এই বাধার কারণে অনেকে আনতে পারেন না। অন্যদিকে স্থানীয় সুতায় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে সরকার ৪ শতাংশ ক্যাশ ইনসেনটিভ দিয়ে আসছে। আমদানি করা সুতায় পোশাক রপ্তানি করলে এই সুযোগ হারাবে।
বিজিএমইএ'র এ সংক্রান্ত ইস্যু নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন টেক্সওয়েভ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "এই সমস্যা সমাধান ও ব্যবসাকে টেকসই করতে বাজার মনিটরিংয়ে টেক্সটাইল খাত, পোশাক খাত ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি হওয়া উচিত। অন্যথায় আমাদের সুতা আমদানির অনুমতি দেওয়া ও স্পিনিং মিলগুলোকে সরাসরি রপ্তানির অনুমতি দেওয়া উচিত।"
অবশ্য বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী খোকন মনে করেন, "সুতার দাম বৃদ্ধির ইস্যুটি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। তিনি বলেন, "আমরা দাম বাড়াইনি। আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বেড়ে গেছে, কিন্তু সে অনুযায়ী সরবরাহ নেই। ফলে তুলা বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। এখন চীনও ভারতের কাছে থেকে সুতা কিনছে। ফলে ভারতও বাংলাদেশকে চাহিদা অনুযায়ী সুতা দিতে পারছে না।"
বিটিএমএ'র অপর একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ হয় মূলত সাপ্লাই ও ডিমান্ডের ওপর। এখন সাপ্লাইয়ের তুলনায় ডিমান্ড বেশি হওয়ায় দাম কিছুটা বাড়বে। আমরা আমাদের সদস্যদের এতে বাধ্য করতে পারছি না। কিন্তু যখন আমরা লোকসান করেছি, তখন কি পোশাক খাতের মালিকরা সুতার দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন? তখন কি আমাদের ব্যাংকের সুদ দিতে হয়নি?"
ভারত থেকে সুতা আমদানি করতে হলে সিএন্ডএফ ব্যয়, এলসি ওপেনিং, ইন্স্যুরেন্স ব্যয়ের পাশাপাশি চার শতাংশ ক্যাশ ইনসেনটিভ মিলবে না। ফলে তা আমদানিকারকদের জন্য সুবিধাজনক হবে না বলে মনে করেন তিনি।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত আট মাস আগে থেকে তুলার দাম বাড়তে থাকে। করোনার কারণে তুলার ফলন কম হওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আগামী মৌসুমেও ফলন কম হবে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন বিটিএমএ সভাপতি।
এ পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে দাম আরও বাড়তে পারে, এমন আশঙ্কায় অনেকেই আগামী তিন চার মাস বা আরও বেশি সময়ের জন্য পোশাকের কাঁচামাল হিসেবে সুতার বুকিং দিয়ে রাখছেন। ফলে চাহিদা বেড়ে গেছে।
আবার জাহাজের সংকটের কারনে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। বিটিএমএ'র সাবেক পরিচালক খোরশেদ বলেন, "কোভিডের আগে বন্দর আব্বাস থেকে ৪০ ফিটের একটি কন্টেইনার আনার ব্যয় ছিলো ১১০০ ডলার, যা এখন ৪ হাজার ডলার হয়ে গেছে, তবুও পাই না।"
একইভাবে তুলা থেকে সুতা, কাপড় ও তৈরি পোশাক উৎপাদন করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠান হলো এনভয় গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান কুতুব উদ্দীন আহমেদ কোভিড থেকে স্বাভাবিক অবস্থা না আসা পর্যন্ত এই সমস্যার আশু সমাধান দেখছেন না।
তিনি বলেন, "বাজারে চাহিদা এবং সরবরাহ ব্যবস্থায় জোর করে টেকসই সমাধান আসবে না।"