স্বনির্ভরতার আলোতে শখকে অর্থকরী করে তুললেন তরুণ উদ্যোক্তা
এক সময় শখের বশে গাভী পালন করলেও সেটিকে বর্তমানে ব্যবসায় রূপান্তরিত করেছেন চট্টগ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা এবং ৩৯তম দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন।
বর্তমানে ১৭০টি ভিন্ন প্রজাতির গরুর পালনের পাশাপাশি তার প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৫জন স্থানীয় সহায় সম্বলহীন মানুষের। ডেইরি ফার্ম ও মাছ চাষে বর্তমানে একজন সফল খামারি এই কাউন্সিলর।
চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গার ফুলছড়ি এলাকায় ঢুকতেই চোখে পড়বে কেজিএন এগ্রো ফার্ম। ৮৪টি উন্নত জাতের গাভি রয়েছে এ খামারে। ৮০ শতক জমিতে স্থাপিত গরুর এ খামারের জমিতে বোনা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ঘাস। গরুকে প্রাকৃতিক এসব ঘাস খাওয়ানো হয়। রাজনীতির পাশাপাশি জিয়াউল হক নিজের হাতে গড়া খামারেই সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন। ২০০৮ সালে গড়া শখের এই খামারে শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থান গড়তে ধীরে ধীরে এর পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন। এই খামার থেকে স্বল্প পরিসরে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের মাধ্যমে স্থানীয় মানুষের চাহিদা মেটাতেও সচেষ্ট কেজিএন এগ্রো।
জিয়াউল হক সুমনের কেজিএন এগ্রোর শুরুটা ছিল ৬ শতক জমিতে ৮টি গরু নিয়ে। বর্তমান সময়ে রাজনীতিবিদরা ঠিকাদারিসহ শিল্প কারখানা ও বিভিন্ন ব্যবসায় মনোনিবেশ করলেও সুমন হেঁটেছেন ভিন্ন পথে। সুমনের দেখানো পথে বর্তমানে চট্টগ্রামের অনেক তরুণ এগ্রোভিত্তিক খামারে বিনিয়োগ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। পতেঙ্গা-সহ আশেপাশের অনেক তরুণ এখন কেজিএন এগ্রো'র সফলতা দেখতে আসেন। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে সুমন তার সফলতার গল্প শোনান এসব স্বপ্নবাজ তরুণদের। পরামর্শের পাশাপাশি সর্বোচ্চ সাহায্য-সহযোগিতাও করেন তিনি।
এই উদ্যোক্তা জানান, প্রতিবছরই খামারে গরুর সংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে জমির পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে। শুরুতে ৬ শতক জমি নিয়ে ছোট আকারের একটি খামার করলেও এখন ৮০ শতক জমি জুড়ে তার খামার বিস্তৃত। ভবিষ্যত পরিকল্পনা হিসাবে খামারের আয়তন বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। কয়েক বছর আগে ভারত থেকে গরু আমদানির মাধ্যমে কোরবানির গরুর চাহিদা মেটানো হতো। বর্তমানে এই খামারটি কোরবানির ঈদের আগে প্রতি বছর প্রায় এক কোটি টাকা মূল্যের গরু বিক্রি করে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কেজিএন এগ্রো খামার তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ৮৪টি গাভী। যেখানে তিনজন লোক এসব গাভীর দেখাশোনায় ব্যস্ত। এর পাশে রয়েছে বকনা-বাছুর রাখার স্থান। একটি নির্দিষ্ট সময় পর বকনা-বাছুরদের নেয়া হয় তাদের মায়েদের কাছে। দুধ খাওয়ানো শেষে আবার নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে আসা হয়। ছোট-বড় মিলে বকনা বাছুরের সংখ্যা ৫৩টি।
এর একটু দূরে রয়েছে ছোট-বড় ৩৩টি ষাঁড়। ষাড়গুলো মূলত প্রজনন ও কোরবানিতে বিক্রির জন্য লালন-পালন হয়। গত কোরবানির বাজারে ৫০টি গরু বিক্রি হয়েছে। এবারেও ৬০টি গরু কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য রয়েছে।
খামারে থাকা ৮৪টি গাভীর মধ্যে বর্তমানে ৫২টি থেকে দুধ পাওয়া যায়। এভাবে প্রতিমাসেই ৫০ এর কম-বেশি গাভী থেকে দুধ পাওয়া যায়। গড়ে প্রতিদিন সাড়ে ৭৫০ থেকে ৮০০ লিটার দুধ সংগ্রহ হয়। এসব দুধ বিক্রি হয় পাইকারি ও খুচরা দুইভাবে। বেকারি বা পাইকারি পর্যায়ে প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হয় ৫৭ টাকা দামে। খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হয় ৭০ টাকায়।
সুমনের খামারে ১৫ জন কর্মচারী কাজ করেন। প্রত্যেককে ১৩ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা করে বেতন দিতে হয়। গরু লালন-পালনে ব্যস্ত এসব কর্মচারীদের বেতন বাবদ প্রতিমাসে খরচ লাগে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। গরুর খাবারের জন্য প্রতিমাসে খরচ হয় ১০ লাখ টাকা। খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা দুধ বিক্রি করে লাভ থাকে বলে জানান উদ্যোক্তা সুমন। এছাড়া প্রতিটা গাভী বিক্রি হয় দেড় লাখ থেকে দুই লাখ টাকায়।
জানতে চাইলে খামারের কর্মী আবুল কালাম বলেন, ৭-৮ ধরণের উন্নত জাতের গরু রয়েছে খামারে। তাদের যত্ন করতে হয়; সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত খাবারের সাথে সাথে পরিষ্কার পরিচ্ছনতায় ব্যস্ত থাকতে হয় সবাইকে। নিয়মিত খাবারের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়াতে হয়।
খামারের শুরু কিভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে সুমন বলেন, সময়টা ছিল ২০০৮ সাল। ৮টি গাভী ও ৬ শতক জমি কিনে গাভী পালন শুরু করেন। ভালোমতো যত্ন নেওয়ার পরে গাভীগুলো বেশ মোটাতাজা হয়। একসময় বাছুর হয়। গাভীগুলো দুধ দিতে থাকে।
দিন দিন সুমনের দিন বদলাতে থাকে। দুধ বিক্রির টাকা দিয়ে সংকর জাতের গরু কেনেন এবং গরুর বংশবৃদ্ধিতে মনোযোগী হন। এখন তার খামারে দেশি, শাহিওয়াল, ক্রস, ক্রস সিন্ধি, ফ্রিজিয়ানসহ উন্নত জাতের ৮৪টি গাভী আছে।
গরুর খামারের পাশাপাশি সুমন মাছ চাষ শুরু করেন গত তিন বছর থেকে। দুই একর জায়গা নিয়ে পতেঙ্গা এলাকার গোল্ডেন ব্রিজে করা হয়েছে মাছ চাষ। কার্প জাতীয় মাছ চাষ হচ্ছে পুকুরে। প্রতি তিন মাস অন্তর মাছ বিক্রি হয়। মাছ বিক্রি করে প্রতি বছর আয় হয় প্রায় পাঁচ লাখ টাকা।
খামারে মশা-মাছি, পোকা-মাকড় প্রভৃতি প্রতিরোধের ব্যবস্থা আছে। গরুর খাবার নিয়ে বললেন, 'প্রতিদিন কাঁচা ঘাস, খড়, ভুসি, ভুট্টা, খৈল খাওয়াই। প্রায় দুই বিঘা জমিতে উন্নত জাতের ঘাস নিজেই চাষ করি। বাজার থেকে শুকনা খাবার কিনতে হয়। তবে বছর বছর যেভাবে খাবারের দাম বাড়ছে তাতে আগের চেয়ে লাভ কমে যাচ্ছে'।
সফল খামারির পাশাপাশি সফল ওয়ার্ড কাউন্সিলরও
জিয়াউল হক সুমন শুধু সফল খামারি নন। সফল একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরও। নগরীর ৩৯তম দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডে দ্বিতীয় মেয়াদে সর্বোচ্চ ভোটে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন এই জনপ্রতিনিধি। পাশাপাশি ইপিজেড এলাকায় তার রয়েছে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা। এছাড়া তিনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মনোনীত বোর্ড সদস্যও।
ব্যক্তিগত জীবনে তিন সন্তানের জনক সুমন। তার যমজ এক ছেলে ও মেয়ে 'ও' লেভেলে পড়ছে নগরীর সানশাইন গ্রামার স্কুল এন্ড কলেজে। ছোট মেয়েটিও একই স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে।