ফুটবল বিশ্বকাপের আসরে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের শক্তির নজির হয়ে থাকবে যে প্রতিষ্ঠান
২০২২ সালের কাতার ফুটবল বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলছে না। তবে লাল-সবুজের সিল সম্বলিত 'মেইন ইন বাংলাদেশ' লোগোর অফিসিয়াল টি-শার্ট থাকবে গ্যালারিতে দর্শক/ সমর্থকদের গায়ে। ফুটবলের এই মহা-আসরের জন্য চট্টগ্রাম-ভিত্তিক সনেট টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিডেটের কারখানায় উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ছয় লাখ পিস ফিফার টি-শার্ট।
ফিফার লাইসেন্সপ্রাপ্ত রাশিয়ান স্পোর্টস চেইন শপ স্পোর্টস মাস্টারের হয়ে এই টি-শার্ট তৈরি করেছে কারখানাটি।
শুধু এবার নয়, ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপেও ফিফার লোগো সম্বলিত ২ লাখ পিস অফিসিয়াল জ্যাকেট তৈরি হয়েছিল সনেট টেক্সটাইলের কারখানায়। ২০২০ সালের ইউরো কাপের জন্যও ৩ লাখ পিস টি-শার্ট তৈরির কার্যাদেশ পেয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।
ক্রীড়া দুনিয়ার সেরা সেরা আসরের জন্য পোশাক উৎপাদনের এসব অনবদ্য অর্জন ছাড়াও, সনেট টেক্সটাইলের শুরু ও পথচলার কাহিনিও কম চিত্তাকর্ষক নয়।
গল্পের শুরুটা গাজী মো. শহীদুল্লাহকে দিয়ে। ২০০০ সালে তিনি স্থানীয় একটি তৈরি আরএমজি কারখানায় কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে পোশাক খাতে কর্মজীবন শুরু করেন। ধীরে ধীরে সেখানকার জিএম মো. হুমায়ুন কবির চৌধুরীর সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। ২০০২ সালে দুজনে একসঙ্গে ক্লিপটন গ্রুপের গার্মেন্টসে যোগ দেন। সেখানে গিয়ে পরিচয় হয় ওই প্রতিষ্ঠানের আরেক কর্মী মো. ইয়াসিনের সঙ্গে।
শহীদুল্লাহ, হুমায়ুন কবির ও ইয়াসিনের বয়সের ব্যবধান থাকলেও- তিনজনের চিন্তার মিল ছিল অনেক। ২০০৭ সালের দিকে আরেকটি কারখানায় ভালো বেতনে যোগ দেন তিনজনই।
কিন্তু, সেখানে গিয়ে মালিক পক্ষের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ হচ্ছিল। তখন তারা নিজেরাই তো কারখানা শুরু করতে পারি! এরপর তারা ২০০৮ সালে চাকরি ছেড়ে দেন। হুমায়ুন কবির, শহীদুল্লাহ ও ইয়াসিনের সঞ্চয়ের পুঁজির ২০ লাখ টাকা, আত্মীয়স্বজন থেকে নেওয়া ঋণসহ মোট ৬৫ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে নামেন তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপনের জন্য।
প্রাথমিক পুঁজি দিয়ে তারা চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ এলাকায় ৩০ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে ১৬,০০০ স্কয়ার ফুটের একটি ফ্লোর ভাড়া নেন। ২৯ লাখ টাকা খরচ করে ২৮টি মেশিনও কেনেন। শুরুতেই অর্থসংকটে পড়ে আরো কিছু ঋণ নিতে হয়। এরপর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে উৎপাদনে যায় কারখানাটি। শুরুতে অন্য কারখানার হয়ে সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করে দুই মাস। এরপর কাজ না পেয়ে একমাস শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়েও বেতন দিতে হয়েছে। তখন কারখানায় ৬৫-৭০ জন শ্রমিক কাজ করত।
সেই থেকে শুরু। এখনও তৈরি পোশাক শিল্পে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে সনেট টেক্সটাইল। তবে শুরু থেকেই একের পর এক প্রতিবন্ধকতা এসে থমকে দিতে চেয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির পথচলা। কিন্তু উদ্যোক্তারা পেছনে ফেরার মানুষ ছিলেন না।
সেদিনগুলির কথা স্মরণ করে গাজী শহীদুল্লাহ বলেন, 'আমরা খুব বিপদের মধ্যে ছিলাম।'
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'আমরা কারখানা শুরু করেছিলাম বৈশ্বিক মন্দার সময়ে। শুরুতে ব্যাংক লোন নেওয়া পরিকল্পনায় ছিল। কিন্তু মন্দার কারণে ব্যাংকও এগিয়ে আসেনি। এরপরই কাজ না পাওয়ায় বড় ধরনের বিপাকে পড়তে হয়েছিল। পুরো ২০০৯ সাল টুকটাক সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করতে করতে কোনোরকমে টিকে ছিলাম। বায়িং হাউজের মাধ্যমে ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে প্রথমবার সরাসরি একটি আমেরিকান অর্ডার পাই। ৭৬ হাজার মার্কিন ডলার মূল্যের ওই অর্ডারটি নবজাতকের রোম্পার সেট তৈরির। পুরো অর্ডার শিপমেন্ট করতে পারিনি। ওই বছরের শেষে অডিট করে দেখি, দুই বছরে আমাদের মোট ১ কোটি ১০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। নতুন কারখানা করেই বিশাল ক্ষতির মুখে পড়ে যাই।'
২০১০ সালেই একটি রাশিয়ান বায়ারদের একটি দল সনেটের কারখানা পরিদর্শন করেন। ওই বছর জুনে ২ লাখ ৪৫ হাজার পিস টি-শার্ট অর্ডার করে তারা। এরপর প্রতিষ্ঠানটি মার্কেটিং বা বিপণনের প্রতি জোর দেয়। ২০১১ সালে পায় আমেরিকান একটি প্রতিষ্ঠানের অর্ডার, যা দিয়ে ওই বছরই সকল ক্ষতি পুষিয়ে সনেট টেক্সটাইলের পরিসর বাড়াতে থাকে। এরপর শুধু সামনে এগিয়ে চলার গল্প।
২০২১ সালে ১৫.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় হয়েছে সনেট টেক্সটাইলের। ২০২২ সালেও ১৫-১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
সনেট টেক্সটাইল ২০১৩ সালে সনেট ফ্যাশন লিমিটেড নামে আরেকটি তৈরি পোশাক কারখানার লাইসেন্স নেয়। এ ছাড়া নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ২০১৭ সালে একটি প্রিন্টিং কারখানাও স্থাপন করা হয়।
সনেটের ৩টি কারখানায় প্রায় ১,৮০০ কর্মী উৎপাদনের চাকা ঘুরাচ্ছেন। তাদের তৈরি টি-শার্ট, জ্যাকেট, অ্যাকটিভ ওয়ার, স্পোর্টসওয়ার যায় রাশিয়ায়। স্লিপওয়ার, আন্ডার-গার্মেন্টস যায় যুক্তরাষ্ট্রে। কিডস আইটেম, রোম্পার, টি-শার্ট যায় ইতালিতে। এ ছাড়া পুরুষ, নারী ও বাচ্চাদের বিভিন্ন পোশাক রপ্তানি হয় জাপানে। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ১ কোটি ২০ লাখ পিস।
এর পরিচালক গাজী মো. শহীদুল্লাহ বলেন, 'রাশিয়ান স্পোর্টস মাস্টার নামে চেইনশপটি আমাদের প্রধান ক্রেতা। কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের ৬৫ শতাংশ তাদের অর্ডারের। ২০১৮ সালে রাশিয়ায় ফুটবল বিশ্বকাপের সময় তারা ফিফার লাইসেন্স পায়। আমাদের তৈরি পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত চেইন শপে বিক্রি হচ্ছে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রপ্তানিতে কিছুটা ধীর গতি এসেছে।'
২০২০ সালের নভেম্বরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে হুমায়ুন কবির মারা গেলে তার ছেলে ইমরুল কবির চৌধুরী পরিচালক হিসেবে ব্যবসায় যুক্ত হন।