এবারের ঈদে কমেছে কাঁচা চামড়ার দাম
এবার কাঁচা চামড়া নিয়ে বড় কোনো বিশৃঙ্খলা না হলেও সরকারের বেধে দেওয়া নির্ধারিত দাম পান নি বিক্রেতারা। মৌসুমি ব্যবসয়ীদের দাবি, তারা যে দামে চামড়া কিনেছেন, প্রায় সেই দামেই বিক্রি করেছেন; এমনকি অনেকক্ষেত্রে তারচেয়েও কম দামে বিক্রি করেছেন।
রাজধানীর সিটি কলেজ মোড়ে ৪ লাখ টাকা দামের গরু চামড়া ৮৫০ টাকায় বিক্রি করেছেন মোহাম্মদ মিন্টু।
"সবকিছুর দাম বাড়লেও কাঁচা চামড়ার দাম বাড়ে না কেন?" বলেন তিনি।
মিন্টু বলেন, গত ১০ বছর আগেও এমন চামড়ার দাম ছিল ২ হাজার টাকা।
ঈদের দিন ঢাকা সিটি কলেজের সামনের রোডে ট্যানারি মালিকসহ চামড়া ব্যবসায়ীদের কাঁচা চামড়া কিনতে দেখা যায়।
মৌসুমি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ স্বপন বলেন, "আমরা চামড়া কিনেছি ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায়। এখানে এসে বিক্রিও করতে হলো সেই দামে।"
"বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমরা যখন চামড়া কিনতে যাই তখন তারা সরকারের নির্ধারিত দামেই বিক্রি করতে চায়। তাদের বোঝাতে পারি না যে সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, লবণ ছাড়া চামড়া নয়," যোগ করেন তিনি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে এবছর ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষ্যে সারাদেশে গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৩টি।
সরকার এ বছর লবণযুক্ত গরুর কাঁচা চামড়ার দাম ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ৪৭-৫২ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০-৪৪ টাকা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া সারাদেশে ছাগলের চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ১৮-২০ টাকা এবং স্ত্রী ছাগলের চামড়ার দাম ১২-১৪ টাকা প্রতি বর্গফুট নির্ধারণ করা হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যমতে, একটি বড় আকারের গরুর চামড়া ৩৫-৪০ বর্গফুট, মাঝারি আকারের চামড়া গড়ে ২৫-৩০ ফুট আর ছোট আকারের গরুর চামড়া হয় ১৬-২০ ফুট।
আড়তদারেরা জানান, একটি চামড়া সংরক্ষণ করতে ৮-১০ কেজি লবণ প্রয়োজন হয়। শ্রমিকের খরচসহ পরিবহন খরচ সব মিলিয়ে প্রতিটি কাঁচা চামড়ায় সংরক্ষণে বাড়তি প্রায় ২৫০-৩০০ টাকা খরচ হয়।
ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, একটি বড় গরুর চামড়া গড়ে ৩৫ বর্গফুট ধরা হলে দাম পড়ে ১৬৪৫- ১৮২০ টাকা। আর মাঝারি গরুর চামড়ার ২৫ বর্গফুট গড়ে ধরা হলে ১১৭৫- ১৩০০ টাকা। ছোট গরুর চামড়া গড়ে ২০ বর্গফুট ধরা হলে সর্বনিম্ন ৯৪০-১০৪০ টাকা দাম হয়।
আর বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিখানার পক্ষ থেকে সংগ্রহ করার চামড়া বিক্রির ব্যপারে বলা হয়েছে ২০১৫ সালে পর এবারই তারা একটু বেশি দামে বিক্রি করতে পেরেছেন । গত বছরও ৫০০ টাকার বেশি দামে চামড়া বিক্রি করতে পারেন নি তারা।
২০১৯ সালে কোরবানির চামড়া নিয়ে একধরনের বিপর্যয় ঘটে যায়। দাম না পেয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চামড়া ফেলে দেন অনেকে। মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনাও ঘটে।
ঈদের পরের দিন সোমবার বিকালে রাজধানীর সবচেয়ে বড় কাঁচা চামড়ার আড়ত পুরান ঢাকার পোস্তায় গিয়ে দেখা যায়, বড় আকারের চামড়া ৮০০ টাকায় বিক্রি হলেও ছোট চামড়ার বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকা। আর ছাগলের চামড়া কেউ কিনছেই না।
পোস্তায় গরুর ৫ টি চামড়া এনেছেন আমির হামজা। ৩টি চামড়া ৮০০ টাকা করে বিক্রি করতে পারলেও ছোট ২টি চামড়া বিক্রি করেছেন ২০০ টাকায়।
মৌসুমি ব্যবসায়ী মোহম্মদ ইমরান বলেন, "১৫০ পিস চমড়া সংগ্রহ করেছি। ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা করে চামড়া কিনেছি কিন্তু পোস্তার আড়তে এসে বিক্রি করেছি গড়ে ৭০০ টাকা করে। আমাদের শ্রমের খরচ, গাড়িভারা বাদ দিলে কোনো লাভ থাকবে না।"
ঈদের আগে পোস্তায় ১৩০০ থেকে ১৫০০ টাকায় চামড়া বিক্রি হলেও এখন হচ্ছে ৭০০ টাকায়, বলেন তিনি।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব খান টিবিএসকে বলেন, "এবার দেড় লাখের মতো চামড়া ঢুকেছে পোস্তায়,"
মৌসুমি ব্যবসায়ীরা দাম কম পাচ্ছে এ বিষয় তিনি বলেন, "বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। অভিজ্ঞতা কম থাকায় অনেকে প্রাথমিক উৎস থেকে বেশি দামে চামড়া কেনেন। কিন্তু পরে সেই দামে আর বিক্রি করতে পারেন না। তাই ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাদের বুঝতে হবে প্রতিটি এ চামড়ায় লবণ লাগানোসহ শ্রমিক খরচ যুক্ত হয়।"
পোস্তায় ছাগলের চামড়া না কেনার বিষয়ে আফতাব খান বলেন, আগে ২০টি ট্যানারি ছাগলের চামড়া কিনতো এখন কিনে ২টি। তাই চাহিদা কম থাকায় ঢাকার ৫০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়েছে।"
ঢাকার বাইরের চামড়ার দাম আরও কম
হিলির মুন্সিপট্টিস্থ চামড়ার আড়তে চামড়া বিক্রি করতে আসা সাগিরুল ইসলাম বলেন, "আমরা যে চামড়া ৪০০ টাকা দাম দিয়ে কিনে নিয়ে এসেছি, সেই চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে ৩৫০ টাকায়। গরুর চামড়া তবুও তো নিচ্ছে কিন্তু ছাগলের চামড়া নিচ্ছেই না।"
হিলির মুন্সিপট্টিস্থ চামড়া ব্যবসায়ী স্বপন মুন্সি বলেন, প্রকারভেদে আড়াইশো, তিনশো ও চারশো টাকা দরে তার ক্রয় করছেন গরুর চামড়া।
উত্তরঙ্গের পশুর চামড়া সবচেয়ে বড় আড়ত রয়েছে দিনাজপুর জেলা শহরের রামনগর এলাকায়।
হাউজিং মোড় এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী হোসেন আলী বলেন, "৩০০ টাকা দিয়ে চামড়া কিনে এই বাজারে বিক্রি করলাম ২৫০ টাকায়। তার ওপর যাওয়া আসার ভাড়া আছে। সবমিলিয়ে একবারে লোকসান।"
যশোরের রাজারহাটে অভয়নগর উপজেলা থেকে চামড়া নিয়ে এসেছিলেন বাসুদেব বিশ্বাস।
তিনি বলেন, "হাটে ২০০ পিস গরু ও ১০০টি ছাগলের চামড়া এনেছি। গরুর চামড়া ৭০০ টাকা দরে আর ছাগলের চামড়া ২০-২৫ টাকা দরে বিক্রি করেছি। গড়ে প্রায় ৫০ হাজার টাকা লোকসান হবে আমার।"
অপরদিকে চামড়া শিল্প নগরীর বাহিরে হেমায়েতপুর হরিনধরা এলাকায় গড়ে ওঠা চামড়ার আড়তগুলোতে ঈদের দিন প্রায় ৮ লক্ষ কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লি. এর চেয়ারম্যান মো. আবুল বাশার।
টিবিএস'কে তিনি বলেন, এখানে (হেমায়েতপুর) মোট ৭২ টি চামড়ার আড়ত রয়েছে, প্রতিটি গরুর চামড়া নূন্যতম ৬০০ টাকা থেকে ১১০০ টাকা পর্যন্ত দাম দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে চট্টগ্রামে ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে চামড়া বিক্রি হয়েছে। এখানে মসজিদ ও মাদ্রাসা থেকে সংগ্রহ করা চামড়া বিক্রি হয়েছে বেশি।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, প্রথম দুই দিনে চট্টগ্রাম মহানগর এলাকা থেকে দেড় লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ করে লবণ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ১৫টি উপজেলায়ও চামড়া সংগ্রহ করে লবণ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।সব মিলে চট্টগ্রামে প্রায় ৪ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ হয়েছে।
এদিকে মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আড়তদাররা যে চামড়া কিনেছেন সেগুলো সপ্তাহখানেক পর কেনা শুরু করবেন ট্যানারি মালিকরা।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, সাভারে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার পিস চামড়া ঢুকেছে। লবণ ছাড়া এ চামড়া ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা করে কেনা হয়েছে বলে জানান তিনি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেশি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
২০২১-২০২২ অর্থবছরে ১০৩ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ১২৪ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার আয় হয়েছে।
- টিবিএস চট্টগ্রাম, হিলি, দিনাজপুর, যশোর, সাভার প্রতিনিধিরা এই প্রতিবেদন তৈরিতে অংশ নিয়েছেন।