জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের হাত ধরে ইন্টেরিয়র ডিজাইন শিল্পের বিকাশ
ক্রমবর্ধমান রিয়েল এস্টেট বাজার, মানুষের আয় বৃদ্ধি এবং নগরায়নের সূত্র ধরে বাংলাদেশে ইন্টেরিয়র ডিজাইন ব্যবসা ও উপকরনের বাজারের আকার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গত দশ বছরের ব্যবধানে এই ব্যবসা ও বাজারের আকার চারগুণ বেড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সংশ্লিষ্টদের মতে এ ব্যবসার বাজারে বিনিয়োগ এখন প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
আগামী পাঁচ বছরে অর্থাৎ ২০২৭ সাল নাগাদ এর পরিধি বর্তমান বাজারের চেয়ে দিগুণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নতুন প্রজন্মের ক্রেতারদের মধ্যে থিম ভিত্তিক ডিজাইন খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশ্বজুড়ে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে থিম ভিত্তিক অন্দর সজ্জা।
ওষুধ উৎপাদন মেশিন আমদানিকারক এআর শামস রবিন ২০২০ সালে বনানীর ১১ নম্বরে লাক্সারি আবাসন প্রকল্পে অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন প্রায় ১২ কোটি টাকায়।
ওই এপার্টমেন্টের ভিতরে সিএডিডি প্রযুক্তি (কম্পিউটার-এইডেড ডিজাইন অ্যান্ড ড্রাফটিং) ব্যবহার করে থ্রি-ডি প্রিন্টিং ডিজাইন করেন। একইসাথে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ড্রয়িং রুমে ৩৬০ ডিগ্রির ভিডিও বা স্থির চিত্র স্থাপন করেছেন।
ড্রয়িং রুমের দরজায় খোলার সঙ্গে সঙ্গে ভিডিও এবং স্থিরচিত্রটিও এমনভাবে চালু হয়, মনে হয় সরাসরি ড্রয়িং রুমে পৌঁছে গেছেন।
এ. আর শামস রবিন দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এই এপার্টমেন্টটি ১৮০০ স্কয়ার ফুটের। ড্রয়িং রুম ছাড়াও আরো চারটি কক্ষে বিদেশী কাঠ দিয়ে মেঝে ও ছাদ ডিজাইন করা হয়েছে। রান্না ঘরে বিশেষ প্রযুক্তির ডিজাইন করা হয়েছে। জানালায় ব্যবহার করা হয়েছে ভার্চুয়াল পর্দা। পুরো এপার্টমেন্ট বিভিন্ন আধুনিক ডিজাইনের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন স্থাপনে খরচ পড়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা।'
এই অ্যাপার্টমেন্টের ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ করেছে ইন্টেরিয়র কনসেপ্টস বিডি নামক একটি প্রতিষ্ঠান।
প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, শুধু এরকম লাক্সারি অ্যাপার্টমেন্ট নয়, তাদের প্রতিষ্ঠান গুলশান-বনানীসহ রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক ভবন, ডুপ্লেক্স বাড়ি, অফিস, হোটেল, রেস্তোরা, করপোরেট অফিস, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এরকম অত্যাধুনিক ডিজাইনের ইন্টেরিয়র ডেকোরশনের কাজ তারা করে থাকেন। যেগুলো সম্পূর্ণ বিদেশি প্রযুক্তি ও উপকরণ ব্যবহার করা হয়।
গত ১৫ বছর ধরে ইন্টেরিয়র কনসেপ্টস বিডি এই ব্যবসা পরিচালনা করছে। এই প্রতিষ্ঠানে চীন, কানাডা ও ইংল্যান্ডের তিনজন স্বনামধন্য ডিজাইনার পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও বুয়েটর কয়েকজন স্থপতি ডিজাইন ডেভেলপের কাজ করেন। আর এসব কাজ করার জন্য চীন ও ভারতের ১৬ জন দক্ষ কর্মী রয়েছে।
ইন্টেরিয়র ডিজাইন ব্যবসা ও উপকরণের এ ব্যবসা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুনভাবে ভূমিকা রাখছে বলে উল্লেখ করেছেন অর্থনীতিবীদরা। তবে এই খাতের জন্য নীতিগতগত উন্নয়ন করলে এটির পরিসর আরো বাড়বে বলে উল্লেখ করেন তারা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এর নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা (ইউআরপি) বিভাগ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে হুমায়ন কবির যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পোস্ট মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। পরবর্তীতে তিনি ইন্টেরিয়র ডিজাইনের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নেন এবং ডক্টোরেট ডিগ্রি লাভ অর্জন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সেখানেই একটি ইন্টেরিয়র ডিজাইন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হন।
পরবর্র্তীতে ২০০৯ সালে বাংলাদেশে স্মার্ট ইন্টেরিয়র নামের একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকেই তিনি এই প্রতিষ্ঠিানে পরিচালনা করছেন। যেখানে বুয়েটের কয়েকজন স্থপতি কাজ করছেন। একইসাথে প্রতিষ্ঠানটি ইন্টরিয়র ডিজাইনের বিভিন্ন প্রযুক্তি ও উপকরন আমাদনির কাজও করে।
গত বছর জুন মাসে স্মার্ট ইন্টেরিয়র বাংলাদেশে ইন্টেরিয়র ডিজাইন ব্যবসা ও উপকরণ ব্যবসা নিয়ে একটি জরিপ করে। সেখানে বলা হয় ২০২১ সালের জুন মাসে বাংলাদেশে এ বাজারের আকার প্রায় ২০ হাজার কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
১৯৯০ সালের পর বাংলাদেশের ইন্টেরিয়র ডেকেরশনে আধুনিকতার ছোয়া পায়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে এই বাজারের প্রবৃদ্ধি শুরু হয়।
স্মার্ট ইন্টেরিয়রের সিনিয়র কনসালটেন্ট স্থপতি ইকবাল মাহমুদ বলেন, আগের বছরগুলোর তুলনায় ২০২০ ও ২০২১ সালে এই বাজারের প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে কোভিডের কারণে। তবে ২০২১ সালের শেষ দিকে আবার নতুন মোড় নিয়েছে এই প্রবৃদ্ধি।
এখন এ খাতে বাংলাদেশের প্রায় ৭ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
আগামী ২০২৭ সাল নাগাদ এই ব্যবসা ও বাজারের পরিধি ৪০ হাজার কোটি টাকায় ঠেকবে বলে গবেষণার অনুমানে বলা হয়েছে।
উপকরণ ও প্রযুক্তি
ইন্টেরিয়র ডিজাইনার ও ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এক সময় দেশি-বিদেশি কাঠ ব্যবহার করে ভবনের ভিতরে বিভিন্ন ডিজাইন করা হতো।
এরপর বিভিন্ন আর্টিফিশিয়াল কাঠের বোর্ড ও প্লাস্টিক শিট ব্যবহার করা হতো। এখনো এগুলো ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এর পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা থ্রি-ডি প্রিন্ট পেপারস বা বোর্ড, ক্যাড প্রযুক্তি, থ্রি-ডি ফটো, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি, স্কেচআপ, ভি-রে এবং থ্রি-ডি ম্যাক্সের সফটওয়্যারের সাহায্যে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইন্টেরিয়র ডিজাইনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ইন্টেরিয়র ডিজাইন কোম্পানি ত্রিমাত্রার এক কর্মকর্তা আসিফ ইব্রাহিম বলেন, নতুন প্রজন্মের ক্রেতারদের মধ্যে থিম ভিত্তিক ডিজাইন খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
এই থিম ভিত্তিক ডেকোরশেনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের নকশা, ইওরোপীয় ধাঁচের অন্দরসজ্জা, পুরনো ভারতীয় ডিজাইন ইত্যাদি বিভিন্ন থিমকে মাথায় রেখে প্রয়োজন মতো ঘর সাজানো হচ্ছে।
এছাড়াও মেঝে ডেকোরেট করতে বহুমুখী ল্যামিনেট মেঝে, শক্ত কাঠের মেঝে, কার্পেট মেঝে, সিরামিক মেঝে চাহিদাও এখন অনেক বলে জানান তিনি।
একইসাথে উইন্ডো কার্টেন ডিজাইন বেশ জনপ্রিয়। এই ডিজাইনের জন্য বক্স প্লেট, চিমটি প্লেট, টেইল্ড প্ল্যাট, আইলেট এবং রড পকেট তৈরি করা হয়।
পাশাপাশি কাচের দেয়াল ডিজাইনও বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। অত্যন্ত শব্দ প্রতিরোধী এবং রঙিন বিশাল কাচের তৈরি এই দেয়াল নির্মাণ করা হয় ঘরের মধ্যে।
স্মার্ট ইন্টেরিয়রের ওই স্টাডিতে বলা হয়, এখন যতো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, তার শতভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করা। আর উপরকণের মধ্যে ২০ শতাংশ উপকরণ দেশে উৎপাদন হয়। বাকিগুলো চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাহজ্যসহ প্রায় ২০টি দেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে।
রাজধানীর হাতিরপুল এলকার ইন্টেরিয়র উপকরণ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান 'ম্যাক্স ইন্টারন্যাশল'র স্বত্বাধিকারী ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুর রহমান বলেন, ইন্টেরিয়র ডিজাইন ও উপকরণ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর যে ২০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ বা বাজার রয়েছে, এর মধ্যে ১৫ হাজার কোটি টাকার উপকরণ মার্কেট। তার মধ্যে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার মার্কেট তৈরি হয়েছে ইন্টেরিয়র প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট।
এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ উপকরণ আমদানি করতে হয়। ৩০ শতাংশ উপকরণ দেশে উৎপাদন হয়।
ইন্টেরিয়র ডিজাইননার প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকাসহ সারাদেশে প্রায় ১০ হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে ইন্টেরেয়ির ডেকোরেশনের। এছাড়াও অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে এই কাজ করে থাকেন।
বাংলাদেশ রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল টিবিএসকে বলেন, এখন রাজধানীতে আবাসন ব্যবসায়ীরা যে সব ভবন ও অ্যাপার্টমেন্ট নির্মান করছে তার সেগুলোর ৯০ শতাংশতেই মূল ভবনের ডিজাইনের বাইরে নতুন করে ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন করা হয়ে থাকে।
অর্থনীতিবীদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সময়ের সাথে সাথে মানুষের রুচি ও পছন্দের পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তনের সাথে সাথে ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন মার্কেট সাজই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে উল্লেখযোগ্য পরিমান জনবলের কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে।
এদের বেশিরভাগই শিক্ষিত, বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যয় ও প্রতিষ্ঠানে এখন এ সংক্রান্ত পৃথক ডিপার্টমেন্ট এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ফলে এই সেক্টর দেশের অর্থনীতিতে একটি নতুন ধারা তৈরি করছে। আবাসন খাতের পাশাপাশি এটিও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে বলে উল্লেখ করেন এই অর্থনীতিবীদ।
"তবে এই খাতের বেশিরভাগ উপকরণ আমদান করায় দেশের অর্থনীততে পুরোপুরি সুফল পাওা যাচ্ছে না। এসব উপকরণের খাত গড়ে তুলতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারে পক্ষ থেকে এই খাতের জন্য নীতিগত উন্নয়ন করলে এটির পরিসর আরো বাড়বে।"