অনিশ্চিত আমদানিকারকেরা অপেক্ষা করে দেখার নীতিতে
ক্রেতাদের জন্য বাজারে কোনো সুখবর নেই। অন্তত এখনই কোনো ভালো খবর দেয়া যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক বাজারে মে মাসের মাঝামাঝি থেকে খাদ্যপণ্যের মূল্য কমতে থাকে। এরপর প্রধান খাদ্যশস্য রপ্তানির জন্য কৃষ্ণসাগর বন্দর থেকে নিরাপদে জাহাজ ছাড়ার লক্ষ্যে গত ২২ জুলাই রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন হলে এই দরপতন আরো তরান্বিত হয়। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের ভোক্তারা অচিরেই হ্রাসকৃত মূল্যে পণ্য কিনতে পারবেন এমন সম্ভাবনা কম।
আন্তর্জাতিক বাজারে যখন পণ্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে এবং দেশের বাজারে ডলারের দাম বাড়ছে চড়চড় করে, তখন ব্যবসায়ীরা অপেক্ষা করে সামনে কী হয় দেখার নীতি নিয়েছেন। এর ফলে কমে গেছে আমদানি।
আমদানিকারকরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, বর্তমানে বুকিং শেষে কোনো পণ্য দেশে পৌঁছতে কমপক্ষে দেড় মাস সময় লাগছে। বর্তমানে ডলারের অস্থির দামের কারণে দেড় মাস পর মুদ্রাটির দাম কত টাকায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউই বলতে পারছে না। ফলে এখন কম দামে পণ্য বুকিং দিলেও ডলারের দামের উর্ধ্বগতির কারণে ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তির সময় অনেক বাড়তি টাকা পরিশোধ করতে হবে। ২৫ জুলাই খোলাবাজারে ডলারের দাম রেকর্ড ১১২ টাকায় উঠে যায়। একদিন পর অবশ্য তা ডলারের দাম ১০৮ টাকায় নেমে আসে। গত বৃহস্পতিবার প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছিল ১১০ টাকায়। ২৪ জুলাই এক মাসের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকার অবমূল্যায়ন করেছে।
এছাড়া বর্তমান দামে বুকিং দেয়া পণ্য দেশে পৌঁছার আগেই আন্তর্জাতিক বাজারে সেসবের দাম আরও কমে যাওয়ার শঙ্কা আছে বলেও জানান আমদানিকারকরা।
ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমে গেলেও ঝুঁকি কমাতে সতর্কতার সঙ্গে আমদানি ঋণপত্র খুলছেন ব্যবসায়ীরা।
দেশের ভোগ্যপণ্য খাতে বাজারে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে সিটি গ্রুপ। দেশের বাজারে বর্তমান ডলার সংকট এবং বিশ্ববাজারে পণ্যের দামের ওঠানামা নিয়ে সতর্ক এই গোষ্ঠীটিও।
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা টিবিএসকে বলেন, বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশে দাম কমবে এই আশায় ক্রেতারা কেনাকাটা কমিয়ে দেন।
'আগের এলসি রেটে বিক্রি করলেও বিক্রেতারা পণ্য কিনতে চান না। ভোক্তারা ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, ফ্রেইট চার্জ, পরিবহন খরচ এবং কারখানার খরচ বিবেচনা করেন না। ফলে বিশ্ববাজার স্থিতিশীল হওয়ার আগে আমদানিকারকরা ঝুঁকি নেন না,' বলেন তিনি।
পিএইচপি ফ্যামিলির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, ডলারের ঊর্ধ্বগতির কারণে পণ্য বা শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য বর্তমানে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে রক্ষণশীল অবস্থান নিয়েছে। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু পণ্যের দাম কমলেও ডলারের বর্তমান মূল্যে নতুন করে এলসি দিয়ে আমদানি করে তা থেকে লাভবান হতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।
তবে আন্তর্জাতিক বাজারের দরপতনের এই সময়ে দেশে পণ্য আমদানি কমে গেলে তা আগামী দিনে পণ্যের দামে প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এতে দেশীয় ভোক্তারা আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমার সুফল পাবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
দেশের ভোগ্যপণ্য আমদানি ও বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরাও একই আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, আমদানি কমিয়ে দিয়ে বড় ধরনের লোকসান এড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা।
কমে গেছে এলসি খোলার পরিমাণ
বৈদেশিক বাণিজ্যে শীর্ষে থাকা ইসলামী ব্যাংকে চলতি মাসের প্রথম ২৭ দিনে পর্যন্ত পণ্য আমদানিতে ৪ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা মূল্যের ৩ হাজার ৮৩২টি ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে। অথচ ব্যাংকটিতে জুনে ১০ হাজার ৩০ কোটি টাকা মূল্যের ৬ হাজার ৫৫৭ টি এলসি খোলা হয়েছিল। অর্থাৎ জুনের তুলনায় জুলাইয়ে ৫২ শতাংশের বেশি এলসি কমে গেছে ব্যাংকটিতে। মে মাসে ব্যাংকটিতে ৭ হাজার ২৯০ কোটি টাকা মূল্যের ৫ হাজার ১২১টি এলসি খোলা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, ওই শাখায় ঋণপত্র খোলার পরিমাণ গত মাসের তুলনায় অন্তত ২০ শতাংশ এবং মে মাসের তুলনায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে।
ইসলামী ব্যাংক চকবাজার শাখার স্বাভাবিক সময়ে গড়ে প্রতি মাসে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়। কিন্তু চলতি মাসের প্রথম ২৭ দিনে শাখাটিতে মাত্র ২ কোটি টাকার এলসি খোলা হয়েছে।
একইভাবে অন্যান্য ব্যাংকেও এলসি খোলার হার কমে গেছে।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা প্রতি মাসে ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য অন্তত ১০টি ঋণপত্র খোলে। কিন্তু চলতি মাসের আজ ২৮ তারিখ পর্যন্ত শাখাটিতে ঋণপত্র খোলা হয়েছে মাত্র ২টি। যা জুন মাসেও ছিল ৫টি।
এদিকে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা প্রতি মাসে সাধারণত ১০ কোটি টাকার আমদানি এলসি খোলে। কিন্তু শাখাটি চলতি মাসে একটিও এলসি খুলতে পারেনি।
ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চকবাজার শাখার ব্যবস্থাপক শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ভোগ্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী বাজারে দাম আরো বৃদ্ধির সম্ভাবনা থেকে মজুদ বাড়াতে পর্যাপ্ত পণ্য আমদানি করেছে আমদানিকারকরা। কিন্তু বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে টানা দরপতনে দেশীয় বাজারে নিম্নমুখী প্রভাব ও ডলার সংকটে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ভোগ্যপণ্য খাত।
আমদানিতে নিম্নমুখী প্রবণতা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যেও পণ্য আমদানিতে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, এ বছরের জুনে দেশে ৬ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এর আগের মাস মে-তে আমদানি হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারের। যা এপ্রিল ও মার্চে ৭ দশমিক ৭২ বিলিয়ন, ফেব্রুয়ারিতে ৮ দশমিক ৩২ বিলিয়ন এবং জানুয়ারিতে ছিল ৮ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যও বলছে, গত দু-মাসে দেশের প্রধান বন্দর চট্টগ্রাম দিয়ে আমদানির পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
মে মাসের পর থেকে দেশে পণ্য আমদানি কমিয়ে দেয়ার চিত্র উঠে এসেছে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের (চট্টগ্রাম বন্দর) কয়েক মাসের আমদানি অনুমতির তথ্যেও। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, চলতি মাসের ২৬ তারিখ পর্যন্ত আমদানি অনুমতি (আইপি) নেয়া হয়েছে ২২৭টি। যা গতমাসে (জুন) ছিল ১৯৪ টি। তবে মে মাসে ছিল ৪৮০টি। অর্থাৎ মে মাসের তুলনায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সংগনিরোধ কেন্দ্র থেকে আমদানি অনুমতিপত্র কম হয়েছে প্রায় অর্ধেক। আইপির পাশাপাশি আমদানি হওয়া পণ্যের রিলিজ অর্ডারও আশঙ্কাজনক পরিমাণ কমেছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রটির কর্মকর্তারা।
চলতি মাসের প্রথম ২৮ দিনে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে। অথচ মে মাসে এ বন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকার পণ্য।
চলতি বছরের শুরু থেকেই ভোগ্যপণ্যের বিশ্ববাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারির শেষে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে পণ্যবাজারে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। যুদ্ধ ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে আগের সব রেকর্ড ভেঙে চূড়ায় ওঠে ভোগ্যপণ্যের দাম।
চলতি বছরের মার্চে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম টনপ্রতি ১ হাজার ৯৫৭ ডলার ও পাম তেলের দাম ১ হাজার ৭৭৭ ডলার উঠে যায়। এর পর থেকে দাম কমতে কমতে বর্তমানে সয়াবিনের টনপ্রতি দাম ১ হাজার ৩২২ ডলার ও পাম অয়েলের দাম ৮৬০ ডলারে নেমে এসেছে।
রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানি ও কৃষ্ণসাগর বন্দর উন্মুক্তকরণের চুক্তি সইয়ের পর গমের দামও কমতে শুরু করেছে।