বিপিসি লোকসানে, সত্যিই?
বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে প্রতিব্যারেল ৯৪.১২ ডলারে নামে। গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর যা সবচেয়ে কম। কিন্তু, তারপরের দিনই বাংলাদেশের ভোক্তারা ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্ত জেনেছেন।
দেশে জ্বালানি তেলের একক আমদানিকারক সংস্থা- বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরশন (বিপিসি) গত ছয় মাস ধরে দৈনিক ৭৭ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে। এই লোকসান সমন্বয় করতেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কথা জানায় জ্বালানি মন্ত্রণালয়।
কিন্তু, বিপিসির আর্থিক অবস্থা বলছে অন্য কাহিনি।
গত ৮ বছর ধরে সরকারের একমাত্র লাভজনক সংস্থা হিসেবে গ্রাহকদের কাছে বিশ্ববাজারের চেয়ে বেশি দামে তেল বিক্রি করে ৪৮ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে বিপিসি।
দাম না বাড়িয়ে এই হারে লোকসান করতে থাকলেও– মুনাফার টাকায় প্রায় ২১ মাস জ্বালানি সরবরাহ করতে পারতো বিপিসি।
কিন্তু, গত ছয় মাসে তেল বিক্রিতে বিপিসির মোট ৮ হাজার ১৪.৫১ কোটি টাকা পরিচালন লোকসানকে যুক্তি হিসেবে দেখিয়ে গত শুক্রবার জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ তেলের মূল্য ৪২.৫ শতাংশ থেকে ৫১.৬ শতাংশ বাড়িয়েছে– যা ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এর আগে গত নভেম্বরে সরকার একই যুক্তিতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতিলিটারে ১৫ টাকা বাড়ায়।
মূল্যবৃদ্ধিকে সমর্থন করে শনিবার (৬ আগস্ট) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মূল্য সমন্বয় করা ছাড়া তাদের হাতে অন্য কোনো বিকল্প ছিল না।
নিজ বাসভবনে গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, বিপিসির পিঠ এখন দেওয়ালে গিয়ে ঠেকেছে। পরিস্থিতি এতটা খারাপ যে, সংস্থাটি তেল আমদানি বন্ধ করতে প্রায় বাধ্যই হচ্ছিল।
তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেছেন, 'বিশ্ববাজারে যখন দাম কমতে শুরু করেছে তখন তেলের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা দেখছি না'।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায়– গত আট বছরে বিপিসি বিপুল মুনাফা করেছে। বিশ্ববাজারে মূল্য অস্থিতিশীল হলে সরকার দেশেও মূল্য বাড়িয়েছে। কিন্তু, যখন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমতে শুরু করেছে- তখন দেশের বাজারে সে অনুসারে (কমিয়ে) সমন্বয় করা হয়নি'।
বিপিসি– সরকারের সোনার ডিম দেওয়া রাজহাঁস?
পাটকল ও রেলওয়ে-সহ সরকারের সকল সংস্থা যখন লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, তখন রাজস্ব সংগ্রহে সরকারের কাছে সোনার ডিম দেওয়া রাজহাঁস হয়ে উঠেছে বিপিসি।
বিপিসির তথ্যানুসারে, ২০১৮ অর্থবছর থেকে সংস্থাটি শুল্ক, কর ও লভ্যাংশ বাবদ সরকারি কোষাগারে ৫৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা দিয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের তথ্য অনুসারে, নিয়মিত পরিচালন খরচ এবং অন্যান্য কর দেওয়ার পরও বিভিন্ন ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট হিসাবে বিপিসির রয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে, এর তিনটি বিতরণকারী কোম্পানি- পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড ও যমুনা অয়েল কোম্পানির ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যাংক আমানত রয়েছে বলে জানাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশনের তথ্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেকর্ড মূল্যস্ফীতির সময়ে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চাপে পিষ্ট সাধারণ মানুষ। তেলের সাম্প্রতিক এই মূল্যবৃদ্ধি নাগরিকদের ওপর অতিরিক্ত খরচের বোঝা চাপাবে।
বুয়েটের (অবসরপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, এই মূল্যবৃদ্ধি একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না।
'বিশ্ববাজারের মূল্যের সাথে দেশে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে একথা বলা- নির্বুদ্ধিতার শামিল'- মন্তব্য করেন তিনি।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি যেভাবে এড়ানো যেত
বিদ্যমান আমানতের টাকা দিয়ে বিপিসি প্রায় ১৪ মাস তেল সরবরাহ করতে পারতো।
এ ছাড়া, ২০২০ এবং ২০২১ অর্থবছরে সরকারের কোষাগারে ৯ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে করপোরেশনটি, যা দিয়ে দাম না বাড়িয়েও আরও চারমাস লোকসান সমন্বয় করা যেত।
বিপিসি তার তিনটি বিতরণ কোম্পানি- পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও যমুনা অয়েল কোম্পানির ব্যাংক একাউন্টে জমা থাকা আমানত দিয়ে আরও ৫ মাস আগের দামে তেল বিক্রি করতে পারতো।
গত দুই অর্থবছর সরকার জ্বালানি তেল থেকে যে পরিমাণ শুল্ককর আদায় করেছে, তা দিয়ে দাম না বাড়িয়ে আরও অন্তত ১০ মাস জ্বালানি তেল সরবরাহ করা যেত।
এর আগে গত ৪ নভেম্বর বিপিসির লোকসানের কথা বলে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়। সে সময় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছিলেন, বিপিসির আগের লোকসানকে তাদের মুনাফা দিয়ে সমন্বয় করা সম্ভব। এতে জ্বালানির দাম বাড়ানোর চাপ কিছুটা কমানো যায়।
তিনি বলেন, 'সরকার চাইলে ভর্তুকি বা কর কর্তনের মাধ্যমে জ্বালানি তেলের দাম আগের পর্যায়ে রাখতে পারে'।
কিন্তু, সেবারও জ্বালানি তেলের ওপর শুল্ক ও কর কমানো হয়নি– হয়নি এবারেও।
অথচ সব রকমের কর প্রত্যাহার করলে, প্রতিলিটার ডিজেলের মূল্য ৩৬ টাকা কমবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)- এর সূত্র জানিয়েছে, ফার্নেস অয়েল, জেট ফুয়েল, ডিজেল ও অকটেনের আমদানির ওপর কাস্টমস শুল্ক ও অন্যান্য কর বাবদ রাজস্ব কর্তৃপক্ষটি প্রায় ৩৪ শতাংশ কর আদায় করে।
অর্থাৎ, এখন ১১৪ টাকার প্রতিলিটার ডিজেল থেকে ৩৬ টাকা কর আদায় করছে সরকার।
এরমধ্যে কাস্টমস শুল্ক হলো ১০ শতাংশ, ভ্যাট বা মূসক ১৫ শতাংশ, অগ্রিম কর ২ শতাংশ এবং অগ্রিম আয়কর ২ শতাংশ।
এ ছাড়া, সরবরাহ পর্যায়ের নতুন তালিকা অনুসারে, ডিজেলের ওপর দুই ধাপে ভ্যাট আদায় করা হবে ১৬.১৪ টাকা। কেরোসিন, অকটেন এবং পেট্রোলেও যথাক্রমে– ১৬.৩৩, ১৮.৬৮ এবং ১৮.২৩ টাকা ভ্যাট দুই ধাপে কার্যকর হবে।
এই বাস্তবতায়, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সরকার জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণনের বিভিন্ন পর্যায়ে আরোপ করা করের পরিমাণ কমিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ কমাতে পারতো।
এর আগে গত জুনে গ্যাসের দাম বাড়ায় সরকার। এই বাড়তি দামের কারণে ভোক্তাদের গুণতে হবে অতিরিক্ত ৪,৭২২ কোটি টাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান টিবিএসকে বলেন, জ্বালানি তেলে সরকার দু'দিক থেকে মুনাফা করছে। একদিকে জ্বালানি তেলের উপর ৩০%-৩২% হারে শুল্ককর আদায় করছে; অন্যদিকে বিপিসিও দীর্ঘ সময় দাম না কমিয়ে মুনাফা করেছে।
'আমি দাম বাড়ানোর বিপক্ষে নই। বিশাল ভর্তুকির চাপ সামলাতে দাম কিছুটা সমন্বয়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এমন অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই। আর এমন সময় এত বেশি দাম বাড়ানো হলো, যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম পড়তির দিকে'- উল্লেখ করেন তিনি।
প্রতিবেশী ভারত চলতি বছরের মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে মাত্র ১৩ দিনের ব্যবধানে ১১ বার তেলের মূল্য বাড়িয়েছে। কিন্তু, জনগণের ওপর তা যেন বোঝা না হয়ে ওঠে, সেজন্য মূল্যবৃদ্ধির আগে উল্লেখযোগ্য হারে কর কমানো হয়েছে।
গত ৪ নভেম্বরে বাংলাদেশে সরকার যখন তেলের দাম বাড়ায়, তখন ভারত প্রতিলিটার পেট্রোল ও ডিজেলে যথাক্রমে ৫ ও ১০ রুপি করে আবগারি শুল্ক কর্তন করে।
তেলের দাম এর পর আরও কয়েক দফা বাড়ানোর পর– মে মাসে ভারতের অর্থমন্ত্রী পেট্রোল ও ডিজেলে যথাক্রমে ৮ ও ৬ রুপি আবগারি শুল্ক কমানোর ঘোষণা দেন।
এতে প্রতিলিটার পেট্রোল ও ডিজেলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মোট কর নেমে এসেছে যথাক্রমে ১৯.৯ এবং ১৫.৮ রুপিতে। দেশটির জনগণও এর মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব থেকে অনেকটা সুরক্ষা লাভ করেছে।