সংরক্ষণ কৃষি পদ্ধতি, বাংলাদেশের কৃষিখাতের জন্য নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে
জ্বালানি তেল ও সারের দাম বৃদ্ধি দেশে কৃষি সম্ভাবনাকে যখন বাধাগ্রস্ত করছে, তখন কৃষি-বাস্তুসংস্থান ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির নতুন পদ্ধতি– সংরক্ষণ কৃষিকাজ বা কনজারভেশন এগ্রিকালচার (সিএ) নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে।
এ ধরনের চাষাবাদে, মাটি ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় জমি কর্ষণ (হালচাষ) ও ব্যবহারকে ন্যূনতম রাখা হয়। এতে মাটির গুণাগুণ এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা করা যায় অনেকটাই। মাটি, পানি ও (মাটির) আদ্রতা সংরক্ষণের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে এতে, যা সার ও বীজের কার্যকারিতা বাড়ানোর মাধ্যমে জ্বালানি তেল, সময় ও অর্থের সাশ্রয় করে।
সাম্প্রতিক সময়ে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে একটি গবেষণা করেছে ভারতের বিহার এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই পদ্ধতি অবলম্বনের ফলে কৃষিখাতে ব্যবহৃত জ্বালানির সাশ্রয় হয় ৪৬-৬২ শতাংশ। এছাড়াও, কৃষি শ্রমিকের দরকার কমায় ২৬-৪২ শতাংশ। পানি সেচ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা ৮-১৭ শতাংশ এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমবে ১১-১৬ শতাংশ।
গবেষণার পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সংরক্ষণ কৃষিকাজে উৎপাদনশীলতা ৫-১০% এবং কৃষকের আয় বাড়াবে ১৬-৫৬ শতাংশ।
কৃষি-অর্থনীতিবিদদের মতে, এই পদ্ধতিতে আগের ফসল সংগ্রহের পর জমিতে শতকরা ৩০ ভাগ (২০-৩০ সে:মি: উচ্চতায়) ফসলের অতিরিক্ত খড় বা কান্ড রেখে দিতে হয়। এরপর জমিতে নতুন ফসল লাগানোর আগে, অনুমোদিত মাত্রায় নিরাপদ ও সঠিকভাবে আগাছানাশক ব্যবহার করে আগাছা দমন করতে হয়। পরবর্তীতে সহজলভ্য যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে, শুধুমাত্র বপনকৃত জায়গাটুকু বিনা চাষে বা সামান্য চাষে উপযোগী করে চারা/ বীজ রোপন করা হয়।
এতে খুবই সামান্য হালচাষের দরকার হওয়ায়, বেশিরভাগ জমি আগের ফসলের খড়ে ঢেকে থাকে এবং তাতে করে মাটি থেকে পানি বাষ্পীভূত হওয়ার পরিমাণ অনেকটাই হ্রাস পায়।
জমিতে পানি উবে যাওয়া ও বায়ু প্রবাহ থেকে জমি সুরক্ষিত থাকায় মাটির উপরিভাগ খুব নরম থাকে, যা মাটির উর্বরতা বাড়ায়। এই পদ্ধতিতে একদিকে যেমন জমির চাষ কমবে, তেমনি একইসঙ্গে বীজ বপন ও সার প্রয়োগ করা যাবে।
একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, মওসুম অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রথাগত পদ্ধতিতে (conventional tillage-CT) ধান, গম ও ভুট্টাসহ সকল রকমের শস্য ও সবজি চাষাবাদ হয়।
এই পদ্ধতির কৃষিতে, একটি ফসল উৎপাদনের জন্য জমিতে কয়েকবার হালচাষ করতে হয়ে। পানিও বেশি ব্যবহার করতে হয়। এক মওসুমে শুধু একটিই ফসল পাওয়া যায়। এতে মাটির ক্ষয় বৃদ্ধি পায়; জ্বালানি এবং পরিশ্রমসহ সংশ্লিষ্ট সকল কাজে কৃষককে অতিরিক্ত পরিশ্রম ও খরচ করতে হয়। এছাড়াও, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন হয়।
দেশে জ্বালানি তেলের সাম্প্রতিক দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে কৃষি- অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, সংরক্ষণ কৃষি পদ্ধতি অবলম্বন করে বাংলাদেশের কৃষিখাতকেও সাশ্রয়ী করা সম্ভব।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন- বিএডিসি-র সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, দেশে প্রায় ১৬ লাখ সেচযন্ত্র আছে। এর মধ্যে প্রায় ৭০ ভাগ ডিজেলচালিত, বাকি বিদ্যুৎচালিত। সেচ ছাড়াও জমি কর্ষণ (যান্ত্রিক হাল-চাষ)সহ ডিজেল কৃষিখাতের অন্যান্য কাজেও লাগে। সব মিলিয়ে সারা বছর কৃষিখাতে প্রায় ১১ লাখ টন ডিজেল লাগে। শুধুমাত্র সেচেই লাগে ৬-৭ লাখ টন।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের অতি-সাম্প্রতিক দেওয়া তথ্য বলছে, দেশের বিদ্যুৎ বিভাগের ৬টি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির আওতায় বিদ্যমান সেচ সংযোগ রয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজারের বেশি। সবকটি সংযোগ একসাথে সচল থাকলে ২ হাজার ২২৮.৫০২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও কৃষি-অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. এম এ সাত্তার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, উপকূল অঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় এখনও প্রথাগত চাষাবাদ পদ্ধতি অবলম্বন করে কৃষকরা।
তিনি বলেন, এখন পাশ্ববর্তী দেশ ভারত সংরক্ষণ কৃষি পদ্ধতির দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। সেখানে প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর জমিতে এখন এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।
'কৃষির খরচের ৪৩% ব্যয় হয় সেচের জন্য। বর্তমানে যে পরিস্থিতি, এই সময়ে কৃষিখাতকে সংকট থেকে উত্তরণে সংরক্ষণ কৃষিকাজ একমাত্র উপায়, যা কৃষকদের বাঁচাতে পারে'।
তবে তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে এখনো এই পদ্ধতি সেভাবে পরিচিত হয়ে উঠেনি। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
'কারণ, এই সময় যদি কৃষিখাতে জ্বলানি খরচ কমানো সম্ভব হয়, তাহলে কৃষক ও দেশ উভয়েই উপকৃত হবে'- যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশে সংরক্ষণ কৃষির সম্ভাবনা:
'সংরক্ষণ কৃষি চর্চা অবলম্বনে জ্বালানি উৎপাদনশীলতা বাড়তে পারে এবং উপকূলীয় বাংলাদেশে মাটির ক্ষয় ও গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমবে' শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেনটি প্রস্তুত প্রকাশ করেছে দ্য ইন্টারন্যাশনাল মেইজ অ্যান্ড হুইট ইমপ্রুভমেন্ট সেন্টার (সিআইএমএমওয়াইটি; সংক্ষেপে সিমিট)।
খুলনার বাটিয়া ঘাটা, পটুয়াখালীর কলাপাড়া এবং বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলায় তিন বছর ধরে গবেষণা চালায় সিমিট। বাংলাদেশে এই পদ্ধতির প্রয়োগ নিয়ে এটিই প্রথম গবেষণা।
সংস্থাটি সাম্প্রতিক প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, 'গবেষকদের পদ্ধতি মেনে এবং কৃষকদের ব্যবস্থাপনায় এই তিন বছরে চক্রাকারে ধান ও ভুট্টা চাষের পরীক্ষামূলক চাষাবাদে বিভিন্ন ধরনের জমি কর্ষণ (হালচাষ) এবং শস্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। আমরা দেখেছি, সংরক্ষণ কৃষিকাজে ধান ও ভুট্টার ফলন পদ্ধতিগত পর্যায়ে বেড়েছে ১৫-১৮%, কায়িক শ্রমের প্রয়োজন কমেছে ২৬-৪০ শতাংশ। এছাড়া, মোট উৎপাদন এবং জমিতে হালচাষ খরচ কমেছে ১-১২% এবং শস্য ব্যবস্থাপনার খরচ কমেছে ৩৩-৫৫ শতাংশ।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, 'এটি নিয়ে কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্টরা কাজ করছে। ইতোমধ্যে কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠন আর সংস্থাও বাংলাদেশে পদ্ধতিটি নিয়ে কাজ করছে। আমরা ধীরে ধীরে এই পদ্ধতির দিকে এগিয়ে যাব।'
তিনি আরও বলেন, 'সংরক্ষণ কৃষি পদ্ধতির সুফল অনেক বেশি। কিন্তু, এজন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি কর্মপ্রণালী দরকার। আমরা সেটি নিয়ে ভাবছি'।
বিএডিসি'র চেয়ারম্যান এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বলেন, 'সংরক্ষণ কৃষি (সিএ) খুবই উপযোগী পদ্ধতি। এটি বিস্তারে সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায় ও আন্তর্জাতিক স্তর থেকে সহায়তা দরকার'।