উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর: রাজস্বে মাইলফলক অর্জন
বিমানবন্দরের অবকাঠামোগত সংস্কার ও ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ২০২৩ সালের জুন মাসের আগেই সম্পন্ন হবে একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। যার ছোঁয়া লেগেছে বিমানবন্দরের রাজস্ব আয়ে। এদিকে প্রথমবারের মতো ঢাকার বাইরের বিমানবন্দর হিসেবে শতকোটি টাকা আয় করলো এই বিমানবন্দর।
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বেবিচকের রাজস্ব আয় ১ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। এরমধ্যে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আয় করেছে ১০৬ কোটি টাকা।
গত এক দশকে বেবিচকের রাজস্ব আয়ের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৫ শতাংশের এর কাছাকাছি হলেও গত অর্থ বছরে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অর্জিত রাজস্বের পরিমাণ আগের চাইতে ২০ শতাংশ বেশি।
শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক উইং কমান্ডার এম ফরহাদ হোসাইন খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'গত অর্থবছরের আমরা সর্বোচ্চ রাজস্ব আয় করেছি। ২০২১-২২ অর্থবছরে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যেখানে ১০৬ কোটি টাকা আয় করে, সেখানে এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮৬ কোটি টাকার রাজস্ব আয় করেছিলো।'
বদলে যাচ্ছে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর
চট্টগ্রাম শাহ্ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিমানবন্দর সম্প্রসারণে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যেই বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের কনসালর্টেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে তাদের পরিকল্পনা উপস্থাপন করবে।
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বেসামরিক বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সেবার মান উন্নত করতে ৭০ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
বিমান বন্দরের রানওয়ে ওভারলে করণ প্রকল্পের কাজ ৬০ শতাংশের বেশি বাস্তবায়িত হয়েছে। বিমানবন্দরে স্থাপন করা হয়েছে বডি স্ক্যানার। ৫৪০ কোটি ৫২ লাখ টাকায় এগিয়ে চলেছে বিমানবন্দরে রানওয়ে ও ট্যাক্সিওয়ের শক্তি বৃদ্ধিকরণের কাজ। শুরু হতে যাচ্ছে বোর্ডিং ব্রিজ স্থাপন, কানেক্টিং করিডোর ও ডিপার্চার লাউঞ্জ নির্মানের কাজ।
এম ফরহাদ হোসাইন খান টিবিএসকে বলেন, 'এ প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ, কার্গোওয়ার হাউস নির্মাণ, প্যারালাল ট্যাক্সিওয়ে, হাই-স্পিড টেক্সিওয়ে, টার্মাক সম্প্রসারণ করা হবে।'
চলমান উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে বিমানবন্দরের পরিচালক উইং কমান্ডার এম ফরহাদ হোসাইন খান বলেন, 'বিমানবন্দরের রানওয়ে ও টেক্সিওয়ের শক্তি বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ দিকে। ৭ম লেয়ারের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। ৮ম লেয়ারের কাজ চলমান রয়েছে। এর মাধ্যমে রানওয়ের কার্পেটিং ও লাইটিং সিস্টেম উন্নত করা হচ্ছে।'
'আশা করা যাচ্ছে আগামী বছরের জুনের আগেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এছাড়া বিমানবন্দরে একটি বোর্ডিং ব্রীজ স্থাপন কানেক্টিং করিডোর ও ডিপার্চার লাউঞ্জ নির্মাণের জন্য ঠিকাচুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। আগামী ২০২৩ সালের ডিসেম্বর নাগাদ এ কাজ সম্পন্ন করা হবে,'জানান তিনি।
এছাড়া শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মাক এক্সটেনশন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে জানিয়ে এম ফরহাদ হোসাইন খান জানান, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নতুন দুটি বিমান রাখার ব্যবস্থা হবে, বর্তমানে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১০টি বিমান টার্মাকে অবস্থান করতে পারে।
নতুন রুটে ফ্লাইট চালুর আবেদন
বৃহত্তর চট্টগ্রামে গভীর সমুদ্র বন্দর, মহেশখালী পাওয়ার হাব, বঙ্গবন্ধু টানেল, বে-টার্মিনাল, বিমানবন্দর থেকে লালখানবাজার পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এসব অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে ব্যবসা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি বিদেশি ব্যবসায়ীদের সরাসরি বিনিয়োগও বাড়ছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বহুগুণে বৃদ্ধির ফলে এসেছে নানা যুগান্তকারী ও ইতিবাচক পরিবর্তন। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক হাবে পরিণত হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম।
কিন্তু বাণিজ্যিক নগরীর বিমানবন্দর হিসেবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেই চট্টগ্রামের এই বিমানবন্দরে। এই অঞ্চলে পর্যাপ্ত যাত্রী থাকলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে সরাসরি ফ্লাইট নেই আন্তর্জাতিক এই বিমানবন্দর থেকে। এজন্য ভারত, মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যাতায়াতকারী যাত্রীদের রাজধানী ঢাকা হয়ে যেতে হয়। ফলে সময় ও অর্থের অপচয় হচ্ছে।
দেশের অন্যতম প্রবেশদ্বার এই বিমানবন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন রুটে ফ্লাইট চালু করতে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়েছে আসছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতারা। ঢাকা-চট্টগ্রাম-ব্যাংকক ও চট্টগ্রাম-কলকাতা রুটে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চালুর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে সর্বশেষ গত ১৩ সেপ্টেম্বর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীকে চিঠি দিয়েছেন চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম।
তিনি বলেন, সরকারের ভিশন ২০৪১ সালের উন্নত দেশ বিনির্মাণে চট্টগ্রামকে ঘিরে চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। ফলে চট্টগ্রামে যেমন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসছেন, তেমনি আমদানি, রপ্তানি, চিকিৎসা ও ভ্রমণের কারণে চট্টগ্রাম থেকে থাইল্যান্ড ও ভারতে যাত্রীর সংখ্যা অনেকগুণ বেড়েছে। অথচ এখান থেকে কোনো ফ্লাইট নেই। এতে করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা চট্টগ্রামে আসতে গেলে অথবা চট্টগ্রাম থেকে ব্যবসায়ী ও চিকিৎসা প্রত্যাশীরা এসব দেশে যেতে হলে ঢাকা হয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। যা সময় ও অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি অনেকটা ভোগান্তিরও।
চট্টগ্রাম থেকে যদি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া রুটে কোনো ফ্লাইট চালু না থাকার বিষয়টি দুঃখের বলে অবহিত করে বিমানবন্দর পরিচালক বলেন, 'এক সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া রুটে রিজেন্ট এয়ার ওওয়জ বিমান পরিচালনা করলেও এখন তা বন্ধ আছে। অথচ মালয়শিয়া-সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ভারতগামী অধিকাংশ ফ্লাইট ফুয়েলিংয়ের জন্য শাহ আমানত বিমানবন্দরে নিয়মিত আসেছে।'
'শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হ্যাঙ্গার সুবিধা না থাকায় আন্তর্জাতিক বিমানগুলো এখান থেকে বিমান পরিচালায় উৎসাহি হচ্ছে না। তবে আশা করছি, বঙ্গবন্ধু টানেল ও মিরসরাই-কক্সবাজার ইকোনোমিক করিডোর বাস্তবায়ন হলে ভবিষ্যতে এ রুটে বিমান চলাচল শুরু হবে,' বলেন উইং কমান্ডার এম ফরহাদ হোসাইন খান।
তিনি জানান, বর্তমানে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ছয়টি বিদেশি ও দুটি দেশি এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা করছে। সেগুলো হলো- চট্টগ্রাম-দুবাই রুটে ফ্লাই দুবাই, চট্টগ্রাম শারজাহ ও আবুধাবি রুটে এয়ার আরাবিয়া, চট্টগ্রাম-কুয়েত রুটে জাজিরা এয়ার ওয়েজ, চট্টগ্রাম-মাস্কাট রুটে ওমান এয়ার ও সালাম এয়ার এবং চট্টগ্রাম কলকাতা রুটে স্পাইস জেট। এছাড়া বাংলাদেশ বিমান জেদ্দা, দুবাই, ওমান, শারজাহ ও ইউএস বাংলা মাস্কাট ও দোহা রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
তিনি বলেন, 'শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে প্রতিদিন ১২ টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের আগমন ও বর্হিগমন হয়। পাশাপাশি ১৫ থেকে ১৭ টি অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালিত হয়। এসব ফ্লাইটের মধ্যে আন্তর্জাতিক রুটে বছরে প্রায় ১০ লাখ যাত্রী আসা-যাওয়া করছে। অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীর পরিমাণ প্রায় ৮ লাখ। সব মিলিয়ে এক বছরে এই বিমান বন্দর ব্যবহার করেন সাড়ে ১৭ লাখের বেশি যাত্রী।'
'চলতি বছরে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দুটি নতুন রুট চালু হয়েছে। এরমধ্যে বাংলাদেশ বিমান শারজাহ ও জাজিরা এয়ার ওয়েজ কুয়েতে যাত্রী পরিবহন করছে যা আমাদের একটি অর্জন, যোগ করেন ফরহাদ হোসাইন।