ব্রিকস ব্যাংকের ঋণ কি হাতছাড়া হয়ে যাবে?
ব্রিকস জোটের গঠিত নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে (এনডিবি) বাংলাদেশ যোগ দেওয়ার পর আশা করা হয়েছিল, দেশের বৈদেশিক অর্থায়নের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে সহায়তা করবে এটি।
কিন্তু এক বছর পরে এখন দেখা যাচ্ছে, প্রকল্প প্রস্তাব তৈরিতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর শিথিলতার কারণে এ ব্যাংকে বাংলাদেশ সদস্যপদ পেয়েও বিশেষ লাভবান হচ্ছে না।
এক বছরে ১৯টি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কেবল একটি মন্ত্রণালয় প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করতে পেরেছে বলে জানিয়েছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-এর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।
এদিকে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দাবি, এনডিবি'র ঋণশর্তগুলো নিয়ে তাদের কাছে পর্যাপ্ত ধারণা নেই।
২০২২-২৬ মেয়াদে এনডিবি ৩০ বিলিয়ন ডলারে ঋণকৌশল দিয়েছে। এখান থেকে ৩ বিলিয়ন থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের।
কিন্তু ধীর অগ্রগতির কারণে বাংলাদেশের জন্য ঋণ পাওয়ার এ সম্ভাবনা সীমিত হয়ে পড়ছে বলে জানান ইআরডি'র কর্মকর্তারা।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এনডিবির সদস্য হয় বাংলাদেশ। এরপর, ব্যাংকটি থেকে ঋণ গ্রহণ নিশ্চিত করতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ১৯টি মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) চেয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে।
ঋণদাতা সংস্থাটির বরাত দিয়ে চিঠিতে মন্ত্রণালয়গুলিকে জানানো হয় যে, প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার তহবিল পাওয়া যাবে। কিন্তু, ঢাকায় পানি সরবরাহের একটি ২৪৫ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প ছাড়া এপর্যন্ত অন্য কোনো বড় প্রকল্প প্রস্তাব হাতেই পায়নি ইআরডি।
ইআরডি'র এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আগামী পাঁচ বছরের জন্য সম্প্রতি নিজেদের ঋণ কৌশল ঘোষণা করেছে এনডিবি। তাই ঋণ প্রস্তাব যত তাড়াতাড়ি পাঠানো যায় ততোই ভালো।'
উন্নয়ন সহযোগিদের কাছে প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানোর পরই সাধারণত তাদের সঙ্গে ঋণ গ্রহণের আলোচনা শুরু করা হয়। এরপর সম্মতির ভিত্তিতে প্রাথমিক ঋণ প্রতিশ্রুতির ঘোষণা দেয় বৈদেশিক দাতারা। এভাবে মূল প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তারপর ঋণ অনুমোদন ও চুক্তি সই করা হয়।
প্রস্তাব পাঠানোয় বিলম্বে কমবে ঋণ পাওয়ার সুযোগ
বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের এমন প্রক্রিয়া বর্ণনা করে একজন ইআরডি কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক প্রস্তাব পাঠানোয় বিলম্ব আগামী পাঁচ বছরে এনডিবি থেকে বাংলাদেশের ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা কমাবে।
২০১৪ সালে চীনের নেতৃত্বে গঠিত হয় নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এতে পাঁচটি উদীয়মান অর্থনীতি– ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ছয়টি উন্নয়ন খাতে অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
২০১৭-২১ সাল পর্যন্ত ব্রিকস জোটের ব্যাংকটি ভারত, রাশিয়া, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ৭৪টি প্রকল্পে ২৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ অনুমোদন করেছে। নতুন পঞ্চবার্ষিকী ঋণ কৌশলের আওতায় ২০২২-২৬ মেয়াদে আরও ৩০ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড় করবে এনডিবি।
জাতিসংঘের এসডিজির সাথে সামঞ্জস্য রেখে যেসব খাতে অর্থায়ন করা হবে সেগুলো হলো: পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ও জ্বালানি দক্ষতা, পরিবহন অবকাঠামো, পানি সরবরাহ ও পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা, পরিবেশগত সুরক্ষা, সামাজিক অবকাঠামো, এবং ডিজিটাল অবকাঠামো।
২০২১ সালে বাংলাদেশ, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং উরুগুয়ে ব্রিকস ব্যাংকের সদস্যপদ লাভ করে।
২০১৬ সালে চীনের নেতৃত্বে গঠিত এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে এপর্যন্ত ১২টি প্রকল্পে ২.৭৮ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ।
এনিডিবি'তে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভকে উন্নয়নের নতুন সম্ভাবনা হিসেবে উল্লেখ করেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং এআইআইবির পাশাপাশি ব্রিকস জোটের ব্যাংকটি ঋণ পাওয়ার নতুন উৎস হবে।
প্রকল্প প্রস্তাব তৈরিতে সক্ষমতার অভাব
তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর ঋণ পাওয়ার উপযোগী প্রকল্প পরিকল্পনা তৈরির সক্ষমতায় ঘাটতির কথা আবারও মনে করিয়ে দিয়েছেন তারা।
সক্ষমতা ঘাটতির দিকটি তুলে ধরে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অভ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ. মনসুর বলেন, ঋণ চূড়ান্ত করার আগে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি এবং সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরিতে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকে সহযোগিতা করে বিশ্বব্যাংক বা এডিবির মতো বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা।
'ফলে এডিবি বা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের প্রকল্প সহজে নিতে পারে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। এনডিবি প্রকল্প প্রস্তাব বা প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করছে না, তাই তাদের প্রকল্প অর্থায়ন পেতে আগ্রহ কম সংস্থাগুলোর,' টিবিএসকে বলেন তিনি।
'বিস্তারিত জানায়নি ইআরডি'
তবে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর দাবি করেছে, নতুন ব্যাংক হওয়ায় তাদের এনডিবি'র ঋণশর্ত সম্পর্কে ধারণা নেই। তাছাড়া, ইআরডি থেকেও তাদেরকে বিস্তারিত জানানো হয়নি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এস এম সলিমুল্লাহ বাহার টিবিএস'কে বলেন, 'ইআরডি থেকে এনডিবি'র ঋণ সম্পর্কে ধারণা দিলে ভালো হতো। তাদের অর্থায়নের শর্ত কেমন, তা না জেনে প্রকল্প নেওয়া কঠিন'।
এনডিবির ঋণ রেলওয়ের অর্থায়ন চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'রেলওয়ের প্রায় সব প্রকল্পই বড় প্রকল্প। তাই এনডিবি ঋণের পরিমাণ না বাড়ালে, বড় প্রকল্পে তাদের ঋণ নেওয়া যাবে না।'
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের যুগ্ম-সচিব মাসুমা আক্তার বলেন, পরিকল্পনা কমিশন অনুমোদন না দেওয়ায় মন্ত্রণালয়গুলো তাদের কাছে প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব জমা দিতে পারেনি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে চলতি বছরের আগস্টে ১২০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের একটি প্রকল্পে এনডিবির অর্থায়নের অনুমোদন চেয়ে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু, এখনও সেটি নীতিগত অনুমোদন পায়নি।
রয়েছে আইনি সীমাবদ্ধতাও
এনডিবি অর্থায়নের জন্য একটি আইন নিয়ে কাজ চলার কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ, তবে সেটি এখনো চূড়ান্ত করা যায়নি। আইনটি করার উদ্দেশ্য হলো ব্রিকস ব্যাংকের অর্থায়নে করা প্রকল্পগুলো যেন কিছু শুল্কছাড় পায়। আইনের খসড়াটি এখনও রয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুমোদনের অপেক্ষায়।
এআইআইবি'র মতো এনডিবি ব্যাংকও বাজারভিত্তিক বা ভাসমান সুদহারে ঋণ দেয়। ঋণ পরিশোধের ম্যাচুরিটির ওপর ভিত্তি করে ঋণের সুদহার সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সোফার) +১.৩০ শতাংশ থেকে +১.৬৫ শতাংশ।
এছাড়া ঋণের সঙ্গে 'ফ্রন্ট এন্ড ফি' এবং অঙ্গীকার ফি থাকবে যথাক্রমে ০.২৫ ও ০.৬৫ শতাংশ।
সে তুলনায়, এআইআইবির ঋণের সুদ হার (সোফার) +০.৭৯ থেকে +১.২৯ শতাংশ। ফ্রন্ট এন্ড ফি ০.২৫ শতাংশ এবং অঙ্গীকার ফি ০.৬৫ শতাংশ।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, নতুন ব্যাংক এবং ক্রেডিট রেটিং কম হওয়ার কারণে এনডিবি থেকে ঋণ গ্রহণের খরচ এআইআইবি'র তুলনায় ০.৫১ শতাংশ বেশি।
তবে পরামর্শক ফি'র দিক থেকে চিন্তা করলে এনডিবি ঋণ বেশ সাশ্রয়ী বলে টিবিএস'কে জানান ইআরডির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, 'নমনীয় ঋণ বিশ্বব্যাপী ক্রমে-ই ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে। দরকার হলে আমরা একটি কমিটি গঠন করতে পারি যারা এনডিবির লোনগুলো যাচাই-বাছাই করে আমাদের উপযোগী ঋণটি নির্ধারণ করবে।'