কৃষকদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন
বৈশ্বিক খাদ্য সংকট পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে কৃষিখাতে কম সুদে ঋণ বিতরণ করতে ৫০০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ স্কিমের অধীনে, ব্যাংকগুলো ০.৫০% সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তহবিল নিয়ে কৃষকদের ৪% সুদে ঋণ দেবে। তিন মাস গ্রেস পিরিয়ডসহ সর্বোচ্চ ১৮ মাসে ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন চাষীরা।
২০২৪ সালের ৩০ জুন মেয়াদে এই স্কিম বলবৎ থাকবে জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, প্রয়োজনে মেয়াদ ও তহবিলের পরিমাণ পুনঃনির্ধারণ করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, সাম্প্রতিক বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দুর্বল সরবরাহ ব্যবস্থার কারণে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য এই স্কিম গঠন করা হয়েছে।
কৃষিখাতের জন্য পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠনের এ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বৈশ্বিক খাদ্য সংকট মোকাবেলা করা এবং বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকটের সময় আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে একমাত্র উপায় হলো দেশে খাদ্য ও কৃষি উৎপাদন বাড়ানো। বিশেষ করে, চাল, ডাল, আলু, মৎস্য ও পোল্ট্রি সেক্টরের বাড়তি উৎপাদন দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা থেকে দেশকে নিরাপদ রাখতে পারে।
সে বিবেচনায় সরকারের প্রো-অ্যাকটিভ উদ্যোগে পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করে কৃষকদের মাঝে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ খুবই ইতিবাচক বলে মনে করছেন তারা।
চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কায় সরকার খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন সার ও সেচ সুবিধা নিশ্চিত করাসহ কৃষি ভর্তুকি না কমানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ প্রেক্ষাপটে দেশের আট মাসের খাদ্যের যোগানদাতা বোরো মৌসুমের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক এই তহবিল গঠন করেছে।
অর্থনীতিবিদরা জানান, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণের আগে অন্যান্য এগ্রিকালচারাল ইনপুটসগুলো সময়মতো নিশ্চিত করতে হবে।
যেমন- কৃষক পর্যায়ে পর্যাপ্ত সারের সরবরাহ, সেচের জন্য ডিজেল ও বিদ্যুৎ এবং কীটনাশকসহ অন্যান্য ইনপুট কৃষক পর্যায়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকতে হবে। না হলে শুধু কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে না।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কৃষক পর্যায়ে যথেষ্ট সার, সেচের জন্য ডিজেল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানো না গেলে শুধু অর্থ দিয়ে কৃষক কী করবে? এসব ইনপুট নিশ্চিত করতে না পারলে এই ঋণ কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ভূমিকা রাখবে না।"
"যখন এসব ইনপুটস এভেইলেবল থাকবে কিন্তু তা কেনার মতো টাকা কৃষকের থাকবে না, তখনই এই ঋণ কাজে লাগবে। আমন মৌসুমে সেচে সংকট দেখা দিয়েছে, অনেক এলাকায় সারের সংকটও হয়েছে। বোরো মৌসুমে যাতে সে পরিস্থিতি না হয়, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য কো-অর্ডিনেটেড পলিসি নিতে হবে," যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি এর প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমও একই পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, "কোভিডের সময় কৃষকদের জন্য যে পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করা হয়েছিল, তা প্রকৃত কৃষকরা পায়নি। তাছাড়া, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কৃষকদের ঋণ দিতে অনাগ্রহী থাকে। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে প্রকৃত কৃষক ঋণ পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে।"
তিনি বলেন, স্থানীয় প্রশাসনকে এক্টিভ করে অনাবাদী জমি চাষের আওতায় আনতে হবে এবং বসতভিটায় সবজি চাষকে উৎসাহিত করতে হবে।
"আমাদের সবকিছু উৎপাদনে নজর দিলে হবে না। মূলত চাল, ডাল, আলুসহ প্রধান পণ্যগুলো উৎপাদনে গুরুত্ব দিতে হবে," জানান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ব্যাংকগুলো কৃষি ও পল্লীঋণ নীতিমালা অনুযায়ী কৃষকদের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করবে। তবে শস্য ও শাক-সবজি চাষের জন্য ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও বর্গাচাষিদের জামানতবিহীন সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া যাবে।
সর্বোচ্চ ৫ একর জমিতে ধানসহ বিভিন্ন শস্য ও ফসল চাষের জন্য জামানত ছাড়া ঋণ দেওয়া যাবে। তবে অন্য খাতে ঋণ বিতরণে জামানত গ্রহণে ব্যাংকগুলো নিজেরা সিদ্ধান্ত নেবে।
কম সুদের এই ঋণের অপব্যাবহার বন্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ঋণের অর্থ বা এর কোনো অংশের অপব্যবহার হলে বা বেশি সুদ নিলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেই পরিমাণ অর্থের বিপরীতে আরও ২% এককালীন সুদ আদায় করবে।
এ স্কিমের আওতায় কৃষকদের ঋণ গ্রহণে উৎসাহিত করতে ব্যাংকগুলোকে ফসল মৌসুম শুরুর আগেই বিশেষ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা এবং প্রকৃত কৃষক চিহ্নিত করতে প্রয়োজনে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের সহায়তা নিতে পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কোভিড পরিস্থিতির সময় যখন বিশ্ববাজার থেকে খাদ্য আমদানি ব্যাহত হচ্ছিলো, তখনও কৃষকদের জন্য এ ধরনের একাধিক স্কিম ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রথম পর্যায়ে ৫০০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম থেকে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৪২৯৫ কোটি টাকা। পরের দফায় ৩০০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম থেকে গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ বিতরণ হয়েছে ৩০৫০ কোটি টাকা।
দেশের কৃষি খাতে ঋণ বিতরণের চিত্র
দেশে কৃষিখাতে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবরে) ঋণ বিতরণে হয়েছে ৯৪৬৯ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের তুলনায় ১৯.৭৮ শতাংশ বেশি।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরের এই সময়ে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৭৯০৫ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩০৯১১ কোটি টাকা। এর মধ্যে অর্থবছরের চার মাসে ৩০.৬৩% ঋণ বিতরণ হয়েছে।
সরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৩৩৮২ কোটি টাকা । যা তাদের অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার ২৮.৭৭%। এছাড়া বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ৬০৮৬ কোটি টাকা। তারা বিতরণ করেছে লক্ষ্যমাত্রার ৩১.৭৮%।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে কৃষি ঋণের লক্ষ্য ছিল ২৮ হাজার কোটি টাকা, যার প্রায় পুরোটাই বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো।