২০৪১ সালে মোট বৈদেশিক ঋণের ৮২% হবে বাজার-ভিত্তিক
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) প্রক্ষেপণ অনুয়ায়ী, ২০৪১ সালে বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক অর্থায়নে বাজার-ভিত্তিক ঋণের পরিমাণ– ২০২০ সালের ২৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হবে ৮২ শতাংশের বেশি। একইসময় আনুষ্ঠানিক দাতাদের থেকে প্রাপ্ত অর্থায়নে নমনীয় ঋণ কমায়, বাড়বে ঋণ পরিশোধের ব্যয়।
গত সপ্তাহে এক কর্মশালায় ইআরডির অতিরিক্ত সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ক্রমে বাড়তে থাকায়– আগামী বছরগুলোতে বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার সুযোগ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। এছাড়া, স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ বা এলডিসি গ্রাজুয়েশনের সুবাদে, সরকারি ও বেসরকারি খাতের জন্য বাজার থেকে ঋণ গ্রহণের দুয়ার খুলে যাবে।
২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। আর ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে।
ইআরডির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০২৬ সালে বৈদেশিক ঋণে বাংলাদেশের বাজার-ভিত্তিক অংশ হবে ৪২.৪%; আর সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, ২০৩১ সালে দেশ যখন উচ্চ মধ্য আয়ের দেশ হবে, তখন এটা হবে ৫৫.৭%।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে সরকার যেসব ঋণের গ্যারান্টার রয়েছে- এলডিসি গ্রাজুয়েশন না হলে মোট রপ্তানির তুলনায় তার সুদহার ০.৭ শতাংশ থাকবে। অন্যদিকে, গ্রাজুয়েশন হলে তা ২০৪১ সাল নাগাদ তা ১.২ শতাংশ হওয়ার অনুমান করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ– আইডিএ (বিশ্বব্যাংকের নমনীয়/ রেয়াতি ঋণ সুবিধা) এবং ওসিআর (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের নমনীয়/ রেয়াতি ঋণ সুবিধা)-র পাশাপাশি অনমনীয় ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে মিশ্র অর্থায়নের দিকে গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংক ও এডিবির পর অন্যান্য বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীরাও পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের জন্য অনমনীয় ঋণ ছাড় কমাবে।
২০৪১ সালে মোট বৈদেশিক ঋণের মাত্র ৪.২ শতাংশ হবে নমনীয় ঋণ, যা ২০২০ সালে ছিল ৫৯.৪ শতাংশ।
ইআরডির প্রতিবেদন বলছে, আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতা (ওডিএ) উন্নয়ন অর্থায়নের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। কালক্রমে বাংলাদেশের জিডিপিতে এর অংশ কমলেও, ২০২০ অর্থবছরে তা ছিল জিডিপির ১.৬ শতাংশ। স্থানীয় সম্পদ আহরণে সীমাবদ্ধতার বিবেচনায় এখনো উন্নয়ন প্রকল্প অর্থায়নে ওডিএ'র উল্লেখযোগ্য প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
অনুদানের অংশ কমছে
বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রচেষ্টার পাশাপাশি কারিগরি সহায়তা ও বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)'র মাধ্যমে বিদেশি অনুদান একটি সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশের এলডিসি গ্রাজুয়েশনের প্রেক্ষাপটে এই সমস্ত অনুদান কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্তমানে (সরকারি ও বেসরকারি খাতসহ) বিদেশি উৎস থেকে ১০০ কোটি ডলার অনুদান পাচ্ছে দেশ, এর ৭০ শতাংশই আবার পাচ্ছে এনজিও এবং বেসরকারি উদ্যোগগুলো।
ইআরডি ও জিইডির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০৩১ সালে এনজিওর মাধ্যমে বৈদেশিক অনুদান ১০০ মিলিয়ন ডলারের কম আসবে, যা ২০২০ সালেও ছিল প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের কারণে নমনীয় ঋণ কমবে না। এটা কমবে মাথাপিছু আয় বাড়ার কারণে। আর এ কারণে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ আইডিএ ব্লেন্ড (মিশ্র ঋণসুবিধা) থেকে বিশ্বব্যাংকের আইবিআরডি-র ঋণের যোগ্যতা অর্জন করবে।
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদের মতে, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন বা বিশ্ববাংকের আইডিএ গ্র্যাজুয়েশনে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে, এটা আবার সুযোগও তৈরি করে। আইবিআরডি-র ঋণ যোগ্যতা অর্জন করলে, বৈদেশিক অর্থায়নের একটা বড় দরজা খুলে যাবে বাংলাদেশের জন্য।
"বিশ্বব্যাংকের আইডিএ বরাদ্দ নির্ধারিত থাকে, কিন্তু আইবিআরডি-তে সদস্যরা অনেক বেশি ঋণ নিতে পারবে। ওই সময় আবার আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার থেকে ঋণ গ্রহণের সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। তখন অর্থ পাওয়ার বাধা আর থাকবে না এবং বিনিয়োগ বাড়বে"- তিনি বলছিলেন।
কিন্তু, বেশি ঋণ বাংলাদেশের জন্য বোঝা হবে, নাকি শক্তি হবে– সেটা নির্ভর করছে ঋণের ব্যবহারের ওপর। "বেশি ঋণ নিয়ে একটা দেশ তখন ঋণে ফাঁদে পড়ে, যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সুদহারের চেয়ে কম থাকে। সে তুলনায়, প্রবৃদ্ধি যদি সুদ হারের চেয়ে বেশি থাকে এবং সরকার যদি বাজেট ঘাটতি জিডিপির ২.৫ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে রাখতে পারে, তাহলে ঋণের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি খুবই কম।" এ কারণে ঋণের গুণগত ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, "বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হয় বৈদেশিক মুদ্রায়। এজন্য বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ থাকা জরুরি। দেনার তুলনায় জিডিপির অনুপাত কম হলেও– বৈদেশিক মুদ্রাপ্রবাহে সমস্যা হতে পারে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ভালো থাকলেও বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধি না থাকলে, এই সমস্যা হতে পারে, যেটা বর্তমানে হয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে এলসি নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না।"
বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়াতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার রাখে দেশমুখী রেমিট্যান্স প্রবাহ। "গত দেড় বছর ধরে অভিবাসনে বাংলাদেশের বড় প্রবৃদ্ধি থাকলেও, একটা পর্যায়ে এটা কমে যাবে, তাই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে রপ্তানির ওপর প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত"- বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাজার-ভিত্তিক ঋণ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ বাংলাদেশ তো সব সময় দরিদ্র থাকবে না।
"নমনীয় ঋণ হলো- দরিদ্র দেশগুলোর জন্য। বাজার-ভিত্তিক ঋণের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে সমন্বয় করতে ভালো প্রকল্প নেওয়া যায়, তাহলে আমাদের সমস্যা হবে না। এছাড়া, ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। একইসঙ্গে রফতানি এবং প্রবাসী আয় বাড়াতে সব ধরণের ব্যবস্থা নিতে হবে"।
যেসব বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া দরকার
ইআরডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজার-ভিত্তিক ঋণের কারণে ঝুঁকিও বাড়বে।
উন্নয়ন সহযোগীরা সহজ শর্তে এবং নির্ধারিত সুদ হারে নমনীয় ঋণ দেয়। এতে ঝুঁকি কম থাকে। অন্যদিকে, বাজার-ভিত্তিক ঋণের সুদ হার বাড়ার ঝুঁকি থাকে।
বাজার ভিত্তিক ঋণ নেওয়া হয় লাইবর (এলআইবিওআর) বা সোফার (এসওএফআর) এবং ইউরিবর রেটে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এক-দুই বছর আগে লাইবর রেট ছিল ১ শতাংশের কম। এখন ৬ মাসের লাইবর হার প্রায় ৫ শতাংশ। ফলে ৬ মাসের লাইবর ঋণের জন্য বাংলাদেশকে অনেক বেশি সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
উন্নয়ন প্রকল্পে জুন ২০২২ পর্যন্ত ৬ মাস-ভিত্তিক লাইবর ঋণের প্রতিশ্রুতি আছে মোট ২৩.৫ বিলিয়ন ডলার, যেখানে আউটস্ট্যান্ডিং ঋণের পরিমাণ ১১.৯৮ বিলিয়ন ডলার।
সোফার রেটও এখন ৩.৫ শতাংশের বেশি।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান বলেন, আগামী দিনে বেসরকারি খাতেও বাজার-ভিত্তিক ঋণ বৈদেশিক ঋণের ওপর চাপ বাড়াবে।
বর্তমান বৈদেশিক ঋণের অবস্থা তুলে ধরে– বড় পরিমাণের ঋণের চেয়ে মানসম্মত ঋণ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ইআরডির প্রতিবেদনে।
ইআরডির কর্মকর্তারা বলেন, যদি বৈদেশিক ঋণে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে সুফল আসবে না। এ কারণে মানসম্মত ঋণগ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
জাহিদ হোসেনের বলেন, শুধু মানসম্মত ঋণ গ্রহণ করলে হবে না, মানসম্মতভাবে সেটাকে বিনিয়োগ-ও করতে হবে। 'এটা না হলে- বৈদেশিক ঋণ আমাদের জন্য বোঝা হয়ে যাবে'।
ইআরডির প্রতিবেদনে, ঋণদাতা নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে, দ্বিপাক্ষিক ঋণে– পণ্য বা সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনেক বেশি উচ্চাভিলাষী শর্ত থাকে। কোন ধরণের প্রকল্পে- কোন ধরণের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন– সে বিষয়েও কৌশলী হতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।