বিশ্ব অর্থনীতির এক-তৃতীয়াংশ চলতি বছরে মন্দার কবলে পড়বে, আইএমএফ প্রধানের হুঁশিয়ারি
বিশ্ব অর্থনীতির এক-তৃতীয়াংশ চলতি বছরে মন্দার মধ্যে পড়বে বলে সতর্ক করেছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং চীনে অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়ায়- ২০২৩ সাল এক কঠিন সময় হবে বলেও মনে করেন তিনি। খবর বিবিসির
ইউক্রেন যুদ্ধ, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর উচ্চ সুদহারের চাপে গত বছর থেকেই নাভিশ্বাস উঠতে থাকে বিশ্ব অর্থনীতির। তার ওপর নতুন বোঝা হয়ে উঠেছে চীনে কোভিড-১৯ এর ব্যাপক বিস্তার। এই প্রেক্ষাপটে, নতুন বছর সম্পর্কে এমন ধারণা দিলেন জর্জিয়েভা।
এর আগে গত বছরের অক্টোবরে ২০২৩ সালের 'গ্লোবাল ইকোনমিক আউটলুক' শীর্ষক পূর্বাভাস প্রতিবেদনে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ কমায় আইএমএফ।
এপ্রসঙ্গে সিবিএস নিউজের ফেস দ্য নেশন অনুষ্ঠানে জর্জিয়েভা বলেছেন, 'আমাদের আশঙ্কা বিশ্ব অর্থনীতির এক-তৃতীয়াংশ মন্দার মধ্যে পড়বে। এমনকী যেসব দেশ এর বাইরে থাকবে, তাদের কোটি কোটি জনতা বোধ করবে- তারা হয়তো মন্দার মধ্যেই আছে'।
সিডনিতে আর্থিকখাতের রেটিংস সংস্থা- মুডিসের অর্থনীতিবিদ ক্যাটরিনা ইল বিবিসিকে জানান, বিশ্ব অর্থনীতি সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষণ।
তার মতে, 'আমাদের বেজলাইন পরিস্থিতির দৃশ্যকল্পে আগামী বছরে হয়তো মন্দা এড়ানো যাবে, তবে বিশ্বমন্দা হওয়ার ঝুঁকিই সবচেয়ে বেশি। ইউরোপ মন্দার কবল থেকে রক্ষা পাবে না, আর যুক্তরাষ্ট্রও সেদিকে এগোচ্ছে'।
অক্টোবরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমানোর সময় আইএমএফ জানায়, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তার ফলে সৃষ্ট উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর উচ্চ সুদহার কার্যকর করায়– তারা আগের চেয়েও দুর্বল পরিস্থিতির আশঙ্কা করছে।
এদিকে করোনার বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার নীতি কোনো কাজে না আসায়, শেষপর্যন্ত তা থেকে সরে এসেছে চীন। দেশজুড়ে ব্যাপকহারে করোনা সংক্রমণের মধ্যেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরায় শুরু করতে দেওয়া হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে আইএমএফ প্রধান মনে করছেন, ২০২৩ সালটা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি চীনের জন্য বেশ প্রতিকূল হবে।
জর্জিয়েভা বলেন, 'আগামী কয়েক মাস হবে চীনের জন্য যথেষ্ট কঠিন সময়। এই সময়ে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চল (এশিয়া- প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল) এবং বাকি বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপরও তার নেতিবাচক ছায়া পড়বে'।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মোট সদস্য দেশের সংখ্যা ১৯০। সব সদস্য মিলে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখার মিলিত চেষ্টা করে। এজন্য সংস্থাটির অন্যতম প্রধান কাজ হলো– অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আগাম সতর্কতা দেওয়া।
তাই জর্জিয়েভার মন্তব্যে বিশ্বের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদদের আরও চিন্তাক্লিষ্ট করবে। এই হুঁশিয়ারি, সরকারগুলোর জন্যও উদ্বেগের। তবে এশিয়ার জন্য কিছুটা বেশিই।
মহামারির পর আবার ২০২২ সাল থেকেই দুর্ভোগ বাড়তে থাকে এশীয় অর্থনীতিতে। এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে অব্যাহতভাবে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। এর পেছনে শুধু মূল্যস্ফীতিই নয়, বরং উচ্চ সুদহারও ব্যবসাবাণিজ্যের প্রতিষ্ঠানসহ পরিবারগুলোকে ভুক্তভোগীতে পরিণত করে।
চীনও এর বাইরে নয়। ২০২২ সালের শেষদিকে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে চীনা অর্থনীতিতে দুর্বলতার চিহ্ন উঠে আসে।
চীনের পারচেজিং ম্যানেজার্স ইনডেক্স (পিএমআই) সূচকে দেখা যায়, ডিসেম্বরে এসে টানা তিন মাসের মতো কমেছে কারখানা পর্যায়ের কার্যক্রম। তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত হারে এটি ঘটেছে, আর সেটাই ছিল বড় উদ্বেগের বিষয়। পাশাপাশি যেভাবে এখন দেশটিতে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটছে, তাতে কারখানা কার্যক্রমে আরও ধস নামার বিপদ উঁকি দিচ্ছে।
২০২২ সালের শেষ মাসে চীনের ১০০টি শহরে বাড়ির দাম কমে যাওয়ার ঘটনা দেশটির একটি বৃহৎ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা– চায়না ইনডেক্স একাডেমির জরিপে উঠে এসেছে। এসব ঘটনায় চীনের নীতিনির্ধারকরাও চিন্তিত। সংকটের এই সময়ে সকলকে আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি- যুক্তরাষ্ট্রেও ঘনিয়ে আসছে মন্দার ছায়া। এরমধ্যেই নেমেছে ভোক্তা চাহিদায় ধস। এতে আমেরিকার বাজারে চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম-সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তৈরি পণ্যের চাহিদা আরও হ্রাস পাবে।
উচ্চ সুদহারের কারণে এই সংকটকালে ঋণ গ্রহণও হয়ে পড়েছে ব্যয়বহুল। চাহিদা হ্রাস ও পর্যাপ্ত পুঁজির অভাবে অনেক কোম্পানিই ব্যবসা সম্প্রসারণে বিনিয়োগ করবে না। এতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও ধস নামার শঙ্কা রয়েছে।
এতে অনেক বিনিয়োগকারী চলে যেতে পারেন, আর তাতে বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলোই হবে দুর্দশার শিকার। বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ কমায় তাদের জ্বালানি ও নিত্যপণ্য আমদানির সামর্থ্যও কমবে।