তারল্য সংকট, পুঁজিবাজারে সীমিত হচ্ছে ব্যাংকের বিনিয়োগ
তারল্য সংকটের কারণে এক্সপোজার লিমিট অনুযায়ী পুঁজিবাজারে সুযোগ থাকলেও বিনিয়োগ বাড়াতে পারছে না ব্যাংকগুলো।
এদিকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসাবে ব্যাংকের বিনিয়োগ না আসায় তারল্য সংকটের মধ্যে পড়েছে পুঁজিবাজার।
ফলে মূলসূচক ও লেনদেনে মন্দা দেখা দিয়েছে। যদিও গত এক সপ্তাহে পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় লেনদেনে কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গত দুই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে।
ব্যাংকগুলো তাদের মূলধনের ২৫% পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে, একে বলে এক্সপোজার লিমিট।
কিন্তু পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের যে এক্সপোজার লিমিট দেওয়া আছে, সে অনুযায়ী বিনিয়োগ করতে পারেনি পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ৩১টি ব্যাংক, যাদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর আরও সুযোগ রয়েছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, বাড়তি দামে ডলার কিনতে হওয়ায় অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে রয়েছে। আবার দেশের অর্থনৈতিক সংকটে ভোলাটাইল পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজার। ফলে ব্যাংক এখন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের স্বাচ্ছন্দ বোধ করছে না।
তারা জানান, বাড়তি দামে ডলার বিক্রি করে ব্যাংকগুলো ভালো মুনাফা করলেও পুঁজিবাজারে মন্দার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে স্টক মার্কেট থেকে ব্যাংকের রিটার্ন হ্রাস পেয়েছে। ফলে ব্যাংক এখন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে সতর্কতা অবলম্বন করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ফান্ড ক্রাইসিস দেখা দেওয়ায় পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
এতে কমিশন দেখছে, এক্সপোজার লিমিটের মধ্যে ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের সক্ষমতা রয়েছে। তবে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাবে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করেছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।
ফলে এক্সপোজার লিমিটের মধ্যে থেকেই ব্যাংকগুলো আরও ৫০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারবে। এছাড়াও পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়াতে প্রতিটি ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকা করে বিশেষ তহবিল গঠনের সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া এই সুযোগও গ্রহণ করছে ব্যাংক। কমিশন বলছে, কোনো ব্যাংক ফান্ড গঠন করলেও বিনিয়োগ করেনি, আবার কোনো ব্যাংক এখনো ফান্ড গঠন-ই করেনি।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, তালিকাভুক্ত ৩৪টি ব্যাংকের মধ্যে ৩১টির পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের তথ্য পেয়েছে। আর তিনটি কোনো তথ্য এখনো পায়নি।
সূত্র জানায়, এক্সপোজার লিমিট অনুযায়ী, মূলধনের ২৫% পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ থাকলেও একত্রিত এবং একক ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ রয়েছে গড়ে প্রায় ২০ শতাংশের কম। কোনো কোনো ব্যাংকের বিনিয়োগ রয়েছে ১৫ শতাংশ।
এবি ব্যাংক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা, যা মোট মূলধনের ১৯.৭২%। ব্যাংক এশিয়ার বিনিয়োগ প্রায় পাঁচশ কোটি টাকা, যা শতকরা হিসাবে ১৯.০৯%।
সিটি ব্যাংক বিনিয়োগ করেছে সাড়ে চারশ কোটি টাকা, যা মোট মূলধনের তুলনায় ১৫.৮২%, ব্র্যাক ব্যাংকের বিনিয়োগ রয়েছে ১৫.১৪% এবং ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় ১৫%।
তারল্য সংকট থাকায় ব্যাংক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে পারছে না জানিয়ে বিএসইসি চেয়্যারম্যান প্রফেসর শিবলি রুবায়েত-উল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "ব্যাংক, বীমা ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারের বড় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। বেশি দামে ডলার কিনতে হওয়ায় ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট রয়েছে। তারল্য যোগান বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক সহায়তা করছে।"
তিনি বলেন, "পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে ব্যাংকের যে সীমা দেওয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী তারা বিনিয়োগ করছে না। ব্যাংকের বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে না আসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, মুল্যসূচকে চাপ পড়ছে।"
কাজেই ব্যাংকগুলোকে সাধ্যমতো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, "পুঁজিবাজারে ২৫% বিনিয়োগ সীমা ব্যাংকগুলোর জন্য বড় সুযোগ। অনেকে এক্সপোজার লিমিটে সে সীমা দেওয়া আছে, সেটার পুরোপুরি বিনিয়োগ করতে পারে। আবার কেউ চাইলে সীমার চেয়েও কম করতে পারে। তবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ব্যাংকের বিনিয়োগ কৌশলের উপর নির্ভর করে।"
তিনি বলেন, "এখন মুদ্রা বাজারে তারল্য সংকটে রয়েছে, যার কারণেও পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ কম হতে পারে। আবার হয়তো কোনো ব্যাংক আরও কম মূল্যে শেয়ার কেনার জন্য অপেক্ষাও করতে পারে।"
নাম না প্রকাশের শর্তে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে বলেন, "তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোই এখন সংকটে। এর মধ্যে স্টক মার্কেটের মতো ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বিনিয়োগ করা মোটেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না।"
তিনি বলেন, "পুঁজিবাজারে কেন পতন হচ্ছে কারণগুলো সব ব্যাংকই জানে। তাই এক সংকটের মধ্যেই ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে চাইবে না। যদি বাজার ভালো হয়, তারল্য প্রবাহ বাড়ে, সেই ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো আবার পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াবে।"
বিএসইসি-র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর এবং মুখপাত্র রেজাউল করিম টিবিএসকে বলেন, "পুঁজিবাজারে তারল্য সংকটের কারণে কমিশন প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংক মূলধনের ২৫% পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে কিন্তু ৩০টির বেশি ব্যাংক এক্সপোজার লিমিটের নিচে রয়েছে, যাতে ব্যাংকগুলো নতুন করে প্রায় ৫০০০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারবে।"
তিনি বলেন, "পুঁজিবাজারে তারল্য যোগান বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকগুলোকে ২০০ কোটি টাকা করে বিশেষ ফান্ড গঠনের সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু তারপরও কিছু ব্যাংক এই ফান্ড গঠন করেনি আবার কিছু ব্যাংক ফান্ড গঠন করে বিনিয়োগ করছে।"
সুযোগ থাকার পরও কেন ব্যাংকেগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছে না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, "লাস্ট কোয়ার্টারে পুঁজিবাজার ডাউন ট্রেন্ড ছিল, অনেকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে সতর্কতা অবলম্বন করছে। তারল্য সংকটে রয়েছে ব্যাংক। ফলে ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা থাকলেও বিনিয়োগ করেনি। ব্যাংকের তারল্য যোগান বাড়াতে ব্যাংকগুলোকে বন্ড ছাড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।"
নতুন মুদ্রানীতিতে ব্যাংকগুলোর তারল্য যোগান বাড়বে, ফলে পুঁজিবাজারেও ব্যাংকের বিনিয়োগ আসবে বলেও মনে করেন তিনি।