রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ইডিএফের আকার এক বিলিয়ন ডলার কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক
রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) এর আকার এরমধ্যেই এক বিলিয়ন ডলার হ্রাস করে ৬ বিলিয়ন ডলার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফের পরামর্শের সাথে সঙ্গতি রেখে, আগামী ছয় মাসের মধ্যে এর পরিধি আরও ২-৩ বিলিয়ন ডলার কমানো হবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রগুলো জানিয়েছে।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ দিয়ে গঠিত ইডিএফ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণদান পর্যায়ক্রমে বন্ধের পরিকল্পনা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এ উদ্যোগ তারই অংশ।
তবে এতে গত তিন দশক ধরে তহবিলটি থেকে স্বল্প সুদে বৈদেশিক মুদ্রা (বিশেষত ডলারে) ঋণের সুবিধা পেয়ে আসা রপ্তানিকারকরা অসন্তুষ্ট হবেন বলেই মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত ৪৫০ কোটি ডলার ঋণের শর্তাবলী নিয়ে আলোচনার লক্ষ্যে গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকা সফর করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-র একটি প্রতিনিধি দল। সফরকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি ফরেক্স রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় বাণিজ্যিক ঋণ কার্যক্রম থেকে সরে আসার আহ্বান জানান তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা একথা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান।
একইসঙ্গে, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রিজার্ভের হিসাব থেকে ইডিএফ এর মাধ্যমে দেওয়া ঋণকে বাদ দিতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী বলেছেন, এই প্রেক্ষাপটে, বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ প্রদান ফরেক্স রিজার্ভের আওতায় দেখানো যাবে না বলে ইডিএফ- এর ঋণ কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ইতঃপূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য ২০২১ সালের এক সুরক্ষামূলক পর্যালোচনায় রিজার্ভের হিসাবে ইডিএফ তহবিল দেখানোর বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিল আইএমএফ।
এদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইডিএফ থেকে ঋণ ছাড় কমানোর কারণে ব্যাংকিং খাতে চলমান ডলার সংকট আরো তীব্র হচ্ছে। এতে করে, অনেক ব্যাংকই ইডিএফের অধীনে এলসি খোলা বন্ধ করে দিচ্ছে, আর ব্যবসাগুলোর দুর্ভোগ আরও বাড়ছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ব্যাংকগুলো ইডিএফের আওতায় এলসি না খোলায়, আমরা ব্যাপক সমস্যার মধ্যে পড়েছি'।
এক দশকের বেশি সময় ধরে ইডিএফ থেকে স্বল্প-সুদে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণসুবিধা পেয়ে আসা একজন বাইসাইকেল রপ্তানিকারক বলেছেন, এর ফলে ইডিএফ থেকে যে হারে পেতেন, এখন তাদের তার চেয়ে উচ্চ সুদহারে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিতে হবে। এতে ব্যবসার খরচ অনেকগুণ বেড়ে যাবে।
ব্যাংকিং খাতের অভ্যন্তরীণদের মতে, এক সময় লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফার রেটের (লাইবর) সঙ্গে ইডিএফের ঋণের সুদহার নির্ধারিত হতো। কোভিড-১৯ সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা শুরুর আগপর্যন্ত ৬ মাসের গড় লাইবরের সঙ্গে ১.৫% যোগ করে সুদহার নির্ধারিত হতো। তবে করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর তহবিল খরচ কমাতে প্রথম দফায় ২% সুদ নির্ধারণ করা হয়। এরপর গত ২০ জুলাই সুদের হার বাড়িয়ে ৩% করা হয়। সবশেষ গত নভেম্বরে সুদের হার আরও বাড়িয়ে ৪% নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১৩ নভেম্বর থেকে এ নতুন সুদহার কার্যকর হয়েছে।
৪ শতাংশ সুদহারে স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ দিয়ে রপ্তানিকারকদের সমর্থন দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১০ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ইডিএফ গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেও – রপ্তানিকারকরা বলছেন, স্থানীয় মুদ্রায় দেওয়া এই ঋণ ডলারের চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। কারণ, গত বছরের এপ্রিল থেকে টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় দর ২০ শতাংশের বেশি বেড়ে গেছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, 'নতুন চালু করা রপ্তানি সুবিধার তহবিলটি রপ্তানিকারকদের জন্য উপকারী হতে পারে। কিন্তু, ব্যাংক হিসেবে আমাদের (বৈদেশিক সরবরাহকারীদের) ডলারে মূল্য পরিশোধ করতে হয়, এই ডলার আমাদের বাজার থেকে সংগ্রহ করতে হয়'।
রিজার্ভের বাড়তি হিসাব সম্পর্কে আইএমএফ- এর দাবি
ইডিএফ-সহ রিজার্ভ বহির্ভূত সম্পদ যোগ করে বাংলাদেশ ব্যাংক তার ফরেক্স রিজার্ভ ৭.২ ডলার বাড়িয়ে দেখাচ্ছে বলে দাবি করে আইএমএফ। তাদের মতে, এতে ইডিএফ থেকে ঋণদান সম্পর্কিত ঝুঁকিকে যথাযথ আমল দেওয়া হয়নি। বৈশ্বিক দাতাসংস্থাটি বলে, এরফলে রিজার্ভের অর্থ ব্যবহারের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হতে পারে।
আইএমএফ প্রতিবেদনটি প্রস্তুতকালে, ২০২১ সালের জুনের শেষপর্যন্ত ফরেক্স রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ডলার রয়েছে বলে সরকারিভাবে জানানো হয়। আইএমএফ জানায়, এটা ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে এবং প্রকৃতপক্ষে তা ৩৯ বিলিয়ন ডলার রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রগুলোর মতে, বর্তমানে দেশের বর্তমানে গ্রস বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ আছে ৩২.৪৮ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু, আইএমএফের হিসাব অনুসরণ করলে দেখা যায় এর পরিমাণ প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার (নেট রিজার্ভ)।
আইএমএফ এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, একটি দেশের তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকাকে নিরাপদ বলে ধরে নেওয়া হয়। সেদিক থেকে দেখলে একই ধারা চললে বর্তমানের নেট রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশের।
ইডিএফ ঋণের অপব্যবহার
বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কিছু রপ্তানিকারক সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করে, রিজার্ভ থেকে দেওয়া ঋণের অর্থ অপব্যবহার করছে। তারা এই ঋণকে বিশাল ফোর্সড লোনে পরিণত করছে।
ঋণগৃহীতাদের ন্যূনতম সুদে ঋণ দেওয়ার অন্যতম লক্ষ্য থাকে, যাতে তারা দেশে আরও বেশি বেশি রপ্তানি আয় আনেন। কিন্তু, অনেকক্ষেত্রেই বায়াররা মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় কোনো রপ্তানি আয় আসে না। এতে ফোর্সড লোনের পরিমাণও বাড়ছে। এমনটাই উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে।
উদাহরণস্বরূপ; রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের ইডিএফ ঋণের বিপরীতে তৈরি হওয়া ফোর্সড লোনের পরিমাণ ৪১০% বেড়ে ৭ হাজার ১৪১ কোটি টাকা হয় ২০২১ সালে। আগের বছর যা মাত্র এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা ছিল বলে ব্যাংকটির বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
ঋণগ্রহীতা গ্রাহক যদি ম্যাচিউরিটির তারিখে এলসির পেমেন্ট করতে ব্যর্থ হন, তারপরও এদেশের ব্যাংককে বিদেশি ব্যাংকের কাছে ঋণপত্রের দায় নিষ্পত্তি করতে হয়। তখন তারা গ্রাহকের অনুকূলে ফোর্সড লোন তৈরি করে। আমদানি ও রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই গ্রাহকের এলসি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দেরি হতে পারে।
কিছু ব্যাংকের ইডিএফ থেকে পুনঃঅর্থায়ন বন্ধ করা হয়েছে
সময়মতো ঋণের বকেয়া অংশ পরিশোধ না করায় বেশ কয়েকটি ব্যাংককে ইডিএফ থেকে পুনঃঅর্থায়ন (রিফাইন্যান্স) করা বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে করে ব্যাংকগুলোর ২০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি পুনঃঅর্থায়নে আটকে গেছে।
কর্মকর্তারা জানান, বকেয়া পরিশোধ করলেও যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নতুন ইডিএফ ঋণ পাওয়া যাবে, এনিয়েও শঙ্কায় আছে ব্যাংকগুলো।
বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান টিবিএসকে বলেন, সাধারণত ইডিএফ ঋণের অধীনে কাঁচামাল আমদানিতে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলা হলে একটি নির্ধারিত কোড উল্লেখ করতে হয়।
এই কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন বলেন, 'এক্ষেত্রে ব্যাংক গ্রাহকের এলসির পেমেন্ট প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই করে দেয়। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইডিএফ থেকে এই ডলার আমাদের ফেরত দেয়। এই চর্চাই এতদিন চলছিল'। কিন্তু, এখন ইডিএফ থেকে তহবিল পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় অনেক ব্যাংকই ইডিএফ এর অধীনে এলসি খোলা বন্ধ করে দিচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান জানিয়েছেন, ইডিএফ থেকে ডলার না পাওয়ায় আমরা গত বুধবার থেকে ইডিএফ এর অধীনে এলসি খোলা বন্ধ করে দিয়েছি। 'এখন আমরা শুধুমাত্র কাঁচামাল আমদানির ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির ক্ষেত্রে ৬ মাস বা তার বেশি সময়ের জন্য ডেফার্ড পেমেন্টের এলসি খুলছি। রপ্তানি আয় এসব এলসির পেমেন্ট করা হবে'।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণের সাথে জড়িত কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ইডিএফের আওতায় ঋণ ছাড়ের শর্ত কঠোর করা হয়েছে।
তারা জানান, যেসব রপ্তানিকারক ইডিএফ থেকে ঋণ সুবিধা নিয়ে কাঁচামাল আমদানি করেছে, অথচ রপ্তানি আয় ঠিকমতো নিয়ে আসছেন না, তাদের এই তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে না। এসব রপ্তানিকারকদের ঋণ আবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে না পাঠানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
আরও অবনতি হচ্ছে ডলার সংকটের
ইডিএফ এর আকার কমানোয় এর চাপ গিয়ে পড়েছে দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলের ডলারের চাহিদা ও যোগানে। ব্যাংকাররা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্ত ব্যাংক খাতে ডলার সংকটকে আরো তীব্র করছে।
তারা বলেছেন, ইডিএফ থেকে ডলার না পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার সংগ্রহ করতে যাচ্ছে। তবে ব্যাংক খাতে পর্যাপ্ত ডলারের যোগান না থাকায় তারা চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাচ্ছেন না। এমনকি অনেক জরুরি পণ্য আমদানিও ব্যাহত হচ্ছে।
যেমন ডলারের অভাবে এলসির পেমেন্ট করা যায়নি বলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোর জন্য কয়লা কেনা যাচ্ছে না। এতে করে মজুত কয়লা শেষ হয়ে যাওয়ায় এবং নতুন কয়লা আমদানি না হওয়ায় রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র উৎপাদন বন্ধ রেখেছে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান টিবিএসকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইডিএফ থেকে ঋণ কমানোর কারণে চলমান বৈদেশিক মুদ্রার তারল্যে চাপ আরো তীব্র হচ্ছে। 'আমরা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে আমার কাছে ডলার না থাকলে, কীভাবে এলসি খুলবো? তাই আমাকে বাধ্য হয়েই কিছুটা রক্ষণশীল হতে হচ্ছে'।
ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (আইডিএ বা আইডা) এবং বাংলাদেশ সরকারের অংশগ্রহণে ১৯৮৯ সালে যাত্রা শুরু করে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ)। বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দিয়ে রপ্তানিকারকদের সুবিধা দিতে প্রাথমিকভাবে এর তহবিল ছিল ৩০.১৬ মিলিয়ন ডলার। এরপর রপ্তানি যত বেড়েছে, ততো বড় হয়েছে ইডিএফের আকার। ২০১৬ সালের জুনে এই তহবিলের পরিধি আরও ২ বিলিয়ন ডলার বাড়ানো হয়। এছাড়া, সবুজ বা পরিবেশবান্ধব প্রকল্প অর্থায়নে আরও ২০০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়।
দেশের রপ্তানি খাতকে চাঙ্গা রাখতে বিভিন্ন সময় ইডিএফের আকার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি কোভিড-১৯ সৃষ্ট ঘটনায় রপ্তানি বাণিজ্য ব্যাহত হলে, রপ্তানিকারকদের বাড়তি চাহিদা পূরণে সাময়িকভাবে এ তহবিলের আকার ৬ বিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ৭ বিলিয়ন ডলার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।