রমজানের পণ্য আমদানি করতে ডলারের জন্য হাহাকার
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংককে বলেছে, বিদ্যমান ডলার সংকট ও আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলায় অন্যান্য সমস্যার সুরাহা করা না হলে আসন্ন রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে না।
সাম্প্রতিক কয়েক মাসে বিভিন্ন পণ্যের এলসি খোলার হার অনেক কমে যাওয়ার ঘটনায় শঙ্কিত হয়ে আগামী মার্চে শুরু হতে যাওয়া রমজানে ভোগ্যপণ্য আমদানি সহজ করতে ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এলসি খোলার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে রোববার বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ।
জানুয়ারিতে এলসি খোলা-সংক্রান্ত জটিলতা কেটে যাবে বলে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এখন পর্যন্ত পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিঠিতে লিখেছে, 'বরং জানুয়ারি মাসে ভোজ্যতেল ও চিনি আমদানির জন্য আরও কম এলসি খোলা সম্ভব হয়েছে।'
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, 'এলসি কনফার্মেশন ও পেমেন্ট না হওয়ার কারণে প্রতিদিন (ব্যবসায়ীদের) প্রচুর অর্থ ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে এবং পণ্য আমদানির ব্যয় বাড়ছে। রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য নির্দিষ্ট পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ ব্যাংক (রিজার্ভ) থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করা দরকার।'
ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, মার্চে রোজার শুরুতে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে ডিসেম্বর ও জানুয়ারির মধ্যে এলসি খুলতে হবে। কিন্তু গত দুই মাসে বেশিরভাগ পণ্যের এলসি খোলার হার আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক কমে গেছে।
ভোগ্যপণ্যের অন্যতম জায়ান্ট সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, রমজানের চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে চলতি জানুয়ারি মাসে ভোজ্যতেল, চিনি ও মসুর ডালের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের আমদানির জন্য ৩৮৫ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলার জন্য তারা বিভিন্ন ব্যাংকের দ্বারস্থ হলেও ডলার সংকটের কারণে এখনও তা খুলতে পারেননি।
একই অবস্থা আরেক শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য সরবরাহকারী টিকে গ্রুপেরও। গ্রুপটির পরিচালক মো. শফিউল আতহার তাসলিম টিবিএসকে বলেন, 'এলসি খোলার ক্ষেত্রে বলার মতো কোনো উন্নতি হয়নি। চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানির এলসি খুলতে আমরাও চেষ্টা করছি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেখা যাক কী হয়।'
প্রতিশ্রুতি দিয়েও রাখা হয়নি
গত বছরের এপ্রিল থেকে ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট শুরু হলেও গত নভেম্বর পর্যন্ত বেশি দরে এলসি খুলতে পারছিলেন ব্যবসায়ীরা।
জানুয়ারিতে ডলার সংকট কেটে যাবে বলে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতির বদলে ডিসেম্বর থেকে আরও অবনতি হয়েছে।
সময় দ্রুত ফুরাচ্ছে
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোজার এক সপ্তাহ আগে বাজারে পণ্য সরবরাহ করতে হলে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই এলসি খোলা জরুরি। কারণ এলসি খোলার পরও বিভিন্ন পণ্য দেশে আসতে ১৫ থেকে ৩০ দিন সময় লাগে।
পাম তেল আমদানির পর বাজারজাত করতে প্রায় ২০ দিন এবং ক্রুড সয়াবিন তেল পরিশোধন করে বাজারজাত করতে ৪৫ থেকে ৬০ দিন সময় লাগে। অপরিশোধিত চিনি আমদানির পর পরিশোধন শেষে বাজারজাত করতেও প্রায় দুই মাস সময় লাগে।
এলসি পরিস্থিতি
রমজানে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ, খেজুর, ডালসহ কয়েকটি নিত্যপণ্যের চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যায়।
তবে এবার ডলার সংকটের কারণে আমদানিনির্ভর চিনি ও ছোলাসহ কিছু পণ্যের এলসি খোলা কমে গেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
তবে গত ডিসেম্বরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি খেজুর আমদানির এলসি খোলা হয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা। তাছাড়া বাজারে দেশি পেঁয়াজের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকায় রোজায় এর সংকট হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই বলেও জানান তারা।
গত ডিসেম্বরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ক্রুড সয়াবিনের এলসি খোলার পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে। পরিশোধিত পাম তেলের এলসি খোলার হার আগের বছরের একই সময়ের কাছাকাছি হলেও গত ডিসেম্বরে পরিশোধিত সয়াবিন ও ক্রুড পাম তেল আমদানির কোনো এলসিই খোলা হয়নি। অথচ গত বছরের ডিসেম্বরে এ দুটি পণ্যের এলসি খোলা হয়েছিল প্রায় ৩৭,০০০ টনের।
এদিকে ২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বরের তুলনায় গত বছরের একই সময়ে চিনি আমদানি ২ লাখ টনের বেশি কমে গেছে। গত ডিসেম্বরে অপরিশোধিত চিনি আমদানির এলসি খোলা হয়েছে মাত্র ৬৯ হাজার ৫২ টনের, আগের বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫ হাজার ১১৯ টনের।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, চিনি আমদানি কমার আরেকটি কারণ হলো, ব্রাজিলের উৎপাদিত চিনির বড় অংশই চীন কিনে ফেলেছে। অন্যদিকে ভারত চিনি রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে।
এর প্রভাবে ইতিমধ্যে দেশের বাজারে সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়েও বেশি দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে।
ইফতারি পণ্য ছোলা আমদানির চিত্রও হতাশাজনক।
আগের বছরের শেষ ছয় মাসের তুলনায় ২০২২ সালের একই সময়ে ছোলা আমদানি কমেছে ১৪ হাজার ১৬৪ টন। এ বছর ডিসেম্বরে ছোলা আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১৯ হাজার ৮১৮ টনের, আগের বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৭২ হাজার ৯৩৩ টন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোম্পানিগুলোর এলসি খোলার তথ্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছে বলেও জানান তিনি।
মসলা ঘাটতির আশঙ্কা
ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি রোজায় মসলাজাতীয় পণ্য সরবরাহেও ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন আমদানিকারকরা।
কৃষি পণ্যের আমদানিকারক ও শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ত বণিক সমিতির সহসভাপতি হাজী মাজেদ টিবিএসকে জানান, আমদানি কম হওয়ার একটি বড় কারণ হলো, শতভাগ মার্জিন দিয়ে অনেক ব্যবসায়ী এলসি খুলতে পারছেন না। আবার অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ভারত ও চীন আদা-রসুন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করছে।
তবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান জানান, বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডলারের বাড়তি দামের কারণে আদা, রসুনের দাম সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ বৃদ্ধির কথা থাকলেও পণ্যগুলো অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমদানি স্বাভাবিক করতে না পারলে মসলাজাতীয় এসব পণ্যের বাজারদর স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে না। কারণ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত আদা-রসুনে চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে না।
বাজার পর্যবেক্ষণ করছে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর
রমজানের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে এ এইচ এম সফিকুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, 'চিনিসহ দু-একটি পণ্যের আমদানি পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ।
'তবে ব্যবসায়ীরা যাতে অনৈতিক সুবিধা নিতে না পারেন, সেজন্য আগে থেকেই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আমদানি, উৎপাদন এবং সরবরাহ পরিস্থিতি মনিটরিং করছি। মিল থেকে কোনো পণ্য বের হওয়ার পর সেটা ডিলার বা পাইকাররাও যাতে মজুদ করতে না পারে সেজন্য আমরা তৎপর আছি,' জানান তিনি।