ডলার সংকটে রডের দাম সর্বকালের সর্বোচ্চে
আরও একবার অস্থির হয়ে উঠলো ইস্পাতের বাজার। আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে মাত্র ৭ দিনের ব্যবধানে বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) টনপ্রতি রডের দাম ৫,০০০ টাকা বেড়ে পৌঁছেছে সর্বকালের সর্বোচ্চে। বিল্ডিং নির্মাণে অত্যাবশ্যকীয় এই উপাদানের দাম বৃদ্ধিতে সামগ্রিক নির্মাণখাতে ওপর চাপ আরও বেড়েছে।
বুধবার চট্টগ্রামের বিভিন্ন মিলে প্রতিটন প্রিমিয়াম মানের (৭৫-গ্রেড) রড বিক্রি হয়েছে ৯১,০০০ থেকে ৯৪,০০০ টাকায়, অথচ এক সপ্তাহ আগেও এর দাম ছিল ৮৭,০০০ থেকে ৮৯,০০০ হাজার টাকা। ৬০ গ্রেডের রডের দামও ৮৪,০০০-৮৬,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ৮৯,০০০-৯১,০০০ টাকা হয়েছে।
গত বছর মার্চে টনপ্রতি ৯২,০০০ টাকায় পৌঁছানোর পর থেকে রডের দাম ছিল কিছুটা নিম্নমুখী। কোভিড-১৯ এর বিধিনিষেধ কাটিয়ে প্রথমবারের মতো বাজার স্বাভাবিক হওয়ার পর ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দীর্ঘ সময় প্রতিটন রডের দাম ছিল ৫৫,০০০ টাকা।
দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে কারখানা মালিকরা বলছেন, গত দুইমাস ধরে বিশ্বব্যাপী রড তৈরির স্ক্র্যাপের দাম বাড়ছে, আর এর একটি বড় অংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এছাড়া, চট্টগ্রাম ভিত্তিক শিপব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতেও স্ক্র্যাপের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
রডের দাম বাড়ার আরেকটি কারণ হল, ডলার সংকটের কারণে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি; সেইসঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট ও দাম বৃদ্ধির প্রভাবে উৎপাদান ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ইস্পাতের দাম বাড়ছে বলে মন্তব্য কারখানা মালিকদের।
এইচএম স্টিল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার আলম বলেন, "রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে এই শিল্পে সংকট লেগেই আছে। ডলার সংকটের কারণে এখন চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না।"
ইস্পাতের কাঁচামাল আমদানি চাহিদার তুলনায় ২০ শতাংশে নেমে এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "সহসা এই সমস্যা না কাটলে কয়েক মাস পর কাঁচামালের তীব্র সংকট হতে পারে।"
"গত বছরের শেষ কয়েক মাস বিশ্ববাজারে স্ক্র্যাপের দাম নিম্নমুখী থাকলেও ডলার সংকটের কারণে দেশিয় উদ্যোক্তারা সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি। প্রায় দুই মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম আবারো বাড়তে শুরু করেছে। এমন সব সংকটে এই খাতের উদ্যোক্তারা এখন দিশেহারা," যোগ করেন তিনি।
শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ইয়ার্ডে প্রতিটন স্ক্র্যাপ বিক্রি হচ্ছে ৬৮,৮০০ টাকা দামে। মাত্র এক সপ্তাহ আগেও প্রতিটন স্ক্র্যাপের দাম ছিল ৬১,০০০ টাকা। অন্যদিকে, বিশ্ববাজারে বর্তমানে প্রতিটন স্ক্র্যাপের দাম ৪৭০ থেকে ৪৯০ ডলারের মধ্যে, যা গত নভেম্বরে ছিল সর্বোচ্চ ৪৩০ ডলার।
স্ক্র্যাপের পাশাপাশি বেড়েছে ইস্পাতের কাঁচামাল প্লেট ও বিলেটের দামও। বর্তমানে বাজারে প্রতিটন প্লেট ৭৬,৪০০ টাকা ও বিলেট ৮২,০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে বাজারে প্রতিটন প্লেট ৭২,০০০ টাকা ও বিলেট বিক্রি হয়েছে ৭৪,০০০ টাকায়।
চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জ এলাকার রড ব্যবসায়ী ও মেসার্স জামান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী এস এম কামরুজ্জামান বলেন, "মাঝখানে তিন মাস নিম্নমুখী থাকলেও মূলত গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে অস্থির হয়ে উঠেছে ইস্পাতের বাজার। বিশ্ববাজারে স্ক্র্যাপের দাম বৃদ্ধি, ডলার সংকট ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রভাবে রডের দাম কিছুটা বাড়বে, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে তারচেয়েও বেশি যে বিষয়টি কাজ করছে, তা হলো, রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সিন্ডিকেট করে দাম বৃদ্ধিতে কারসাজি করছে।"
এক সময় শুধু চট্টগ্রামেই ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় অর্ধ শতাধিক রড উৎপাদনকারী কারখানা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন সংকটের কারণে গত কয়েক বছরে এসবের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনই বন্ধ হয়ে গেছে উল্লেখ করে কামরুজ্জামান আরও বলেন, "এখন রডের পুরো বাজার ১০ থেকে ১২টি প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি। ফলে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সিন্ডিকেট করে পণ্যটির দাম বাড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে।"