জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে ১৪ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি ওপেনিং কমেছে
আমদানিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা বিধিনিষেধ ও এক্সপোর্ট অর্ডার কমায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে আগের একই সময়ের তুলনায় আমদানি এলসি খোলা প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলারের মতো কমে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ৪৫.৫২ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ৫৯.৪৬ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। অর্থাৎ, এলসি খোলা কমেছে ২৩.৪৫%।
বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডলার সংকট কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি এলসি খোলায় ১০০% পর্যন্ত মার্জিন রাখাসহ নানা কড়াকড়ি আরোপ করে। ফলে ব্যবসায়ীরা ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও বিলাসদ্রব্য আমদানিতে কিছুটা নিরুৎসাহিত হয়। এছাড়া ডলারের যোগানে টানাটানি থাকার কারণে ব্যাংকগুলোও এলসি খোলার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে যায়। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের আমদানি এলসি খোলার আগে রিপোর্ট করার নির্দেশনা দেয় ব্যাংকগুলোকে। রিপোর্ট করা এসব এলসির পণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্য যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন করার নীতি নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ওভার ইনভয়েসিংও কিছুটা কমে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এলসি ওপেনিং কমে যাওয়ার এগুলোই অন্যতম কারণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মনেটারি ভ্যাল্যু বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি এলসি খোলা হয়েছে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য। গত ৮ মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬.৬৮ বিলিয়ন ডলার বা ৩০.০৫% কমে এই খাতে এলসি খোলা হয়েছে ১৫.৫৬ বিলিয়ন ডলারের। এসব ম্যাটেরিয়ালের একটা বড় অংশ আমদানি হয় আরএমজি রপ্তানির কাঁচামাল হিসেবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসব কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা কমিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম টিবিএসকে বলেন, "আমাদের অর্ডার আসার পরিমাণ কমে গেছে, ফলে আমাদের আগের মতো কাঁচামাল লাগছে না, তাই আমরা এলসিও কম খুলছি। আমাদের রপ্তানির ৬০ শতাংশই হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এসব দেশের ক্রেতারা আগের মতো অর্ডার দিচ্ছেন না, সেইসঙ্গে ইতিমধ্যে দেওয়া অর্ডারগুলোও নিতে ডিলে করছেন বা পেমেন্ট পিছিয়ে দিচ্ছেন। মূলত মুদ্রাস্ফীতির কারণে সেসব দেশের গ্রাহকেরা পোষাক কেনা কিছুটা কমিয়েছেন, যেটি অর্ডার কমাতে ভূমিকা রেখেছে। আমাদের অধিকাংশ কারখানা শ্রমিকদের ওভারটাইম কাজ করানো কমিয়ে দিয়েছে। গত মার্চের এক্সপোর্ট ইয়ার-অন-ইয়ার কমেছে। এই ধারাবাহিকতা আরো কয়েকমাস থাকবে বলে ধারণা করছি। তবে আশা করছি, জুন-জুলাইয়ের দিক থেকে আবার অর্ডার বাড়বে।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ক্যাপিটাল মেশিনারিজের আমদানি এলসি খোলা প্রায় ৫৪% কমেছে, পরিমাণের দিক থেকে এটি ২.৫৩ বিলিয়ন ডলারের মতো।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা দেখেশুনে বিনিয়োগ করছেন বলে আমাদের মনে হয়েছে। এছাড়া ক্যাপিটাল মেশিনারিজ বা বিলাসদ্রব্য আমদানির এলসি খোলায় ব্যাংকগুলোও এখন যাচাই-বাছাই বেশি করছে। এসব পণ্যের তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানির এলসি খোলায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ব্যাংক। সেইসঙ্গে আমদানিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ির কারণেও এলসি খোলা কমেছে।"
এলসি ওপেনিং উল্লেখযোগ্য কমার পাশাপাশি এলসি সেটেলমেন্টও কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে পেমেন্ট করা হয়েছে ৫২.০২ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১.২২% কম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যাংকের এমডি জানান, তাদের পেমেন্টের চাপ আগের তুলনায় অনেক কমেছে। তবে এখনো সার, জ্বালানী তেলসহ বেশকিছু বড় অঙ্কের পেমেন্ট বাকি রয়ে গেছে। এসব এলসি ডেফার করা হয়েছিল। সামনের দিনগুলোতে এসব পেমেন্ট করা হলে সেটেলমেন্টের মোট এমাউন্ট বাড়বে।
ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, "ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলাপে যা বুঝতে পেরেছি, এলসি ওপেনিং কমায় সামনের দিনগুলোতে ডলারের উপর চাপ কমতে পারে। ধারণা করছি, আগামী জুন-জুলাই নাগাদ ডলারের চাহিদা ও যোগানে আমরা একটি পজেটিভ ইমপ্যাক্ট দেখতে পারবো।"