অর্থঋণ আদালতে আটকে রয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১১,৫৫২ কোটি টাকা
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিকতম তথ্যমতে, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থঋণ আদালতে ৪,০৭২টি মামলায় – ব্যাংক বহির্ভুত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) ১১,৫৫২ কোটি টাকা আটকে রয়েছে।
৩৫ ঋণগৃহীতার মধ্যে শীর্ষ পাঁচ প্রতিষ্ঠানের কাছেই আটকা সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা আটকা, যা কিনা মোট অর্থদাবির অর্ধেকেরও বেশি।
আর্থিক খাতের অভ্যন্তরীণরা বলেছেন – অর্থঋণ আদালতে নিয়মিত মামলার পরিমাণ বাড়তে থাকা, শুনানিতে দীর্ঘসূত্রিতা, আদালত সংখ্যা কম হওয়া, অর্থঋণ আদালতের রায়ের ওপর হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ এবং মামলার বিবাদীদের অনুপস্থিতি – এই পরিস্থিতির দিন দিন আরো অবনতির প্রধান কারণ।
২০২১ সালের শেষপর্যন্ত অর্থঋণ আদালতে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৮,৫১৮ কোটি টাকা অর্থদাবি সম্পর্কিত মামলার সংখ্যা ছিল ৩,৯১৯টি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরের এক বছরে মামলার সংখ্যা বাড়ে ৭৮৩টি আর অর্থদাবির পরিমাণও বেড়েছে ৩,০৩৪ কোটি টাকার বেশি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কায়সার হামিদ বলেন, 'অর্থঋণ আদালতে মামলার সংখ্যা অনেক বেশি। সেই অনুপাতে, আদালতের সংখ্যা ও বিচারক অনেক কম। তাছাড়া বিচারকার্য বিলম্বিত করতে খেলাপি গ্রাহকরা বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকেন, এমনকী মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষকে তারা আদালতে যথাসময়ে হাজির করেন না'।
'ফলে মামলার অভিযোগ গঠন ও বিচার প্রক্রিয়া ঝুলে যায়, দুর্ভোগে বাড়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। তার ওপর আবার, খেলাপি গ্রাহকদের তাদের মোট গৃহীত ঋণের একটি নির্দিষ্ট অংশ জমা দিয়ে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রায়ই তারা এ সুযোগের অপব্যবহার করছে। এসবের পাশাপাশি অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে নানা ধরণের জটিলতা রয়েছে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি।
একই মতপোষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্যানেল আইনজীবী মো. রুহুল আমিন ভূঁইয়া টিবিএসকে বলেছেন, অর্থঋণ আদালতের পুরো বিচার প্রক্রিয়াটা বেশকিছু কারণেই দীর্ঘ। মামলা নিষ্পত্তিতে সময় লাগার অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে, সমন জারিতে দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়া এবং বিবাদী পক্ষের নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালতে মামলা নিয়ে যাওয়া অন্যতম প্রধান কারণ'।
তিনি আরও বলেন, 'অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তির পরও জাল কাগজপত্রের কারণে অনেক ক্ষেত্রে ঋণদাতারা অর্থ আদায় করতে পারে না। কারণ, বড় গ্রাহকদের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় তারা কাগজপত্র যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করে না। ফলে যখন ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখা সম্পত্তি বিক্রি করে অর্থ আদায় করতে যায়, তখন দেখে সেসবের অতি-মূল্যায়ন করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বড় ঋণগ্রহীতারা এসব অনিয়ম করছে'।
'এছাড়া ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষ ঋণ নিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। তখন তারা ঋণ দিতে বাধ্য হন। এ খাতের জন্য এটা বড় সমস্যা'- যোগ করেন তিনি।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনাদায়ী অর্থ এবং কলমানি মার্কেট থেকে অর্থ ধার নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা – দীর্ঘসময় ধরে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারল্য সংকটের মধ্যে রেখেছে।
গত ১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এনবিএফআইগুলোকে আন্তঃব্যাংক কলমানি মার্কেট থেকে অর্থ ধার না করার নির্দেশ দেয়। এর পরিবর্তে বন্ড জারির মাধ্যমে তাদের তহবিল সংগ্রহ করতে বলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালের শেষে অর্থঋণ আদালতে মামলার সংখ্যা ৭২,১৮৯টি। এসব মামলায় অর্থদাবির পরিমাণ রয়েছে ১,৬৬,৮৮৬ কোটি টাকা। আগের বছরের তুলনায় মামলা বেড়েছে ৩,৯১৮টি এবং মামলায় দাবিকৃত টাকার পরিমাণ বেড়েছে ২৩,১৯২ কোটি টাকা।
এরমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অর্থদাবি সবচেয়ে বেশি বা ৭১,৭৬৪ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ২,৪৬৮ কোটি টাকা, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৮৮,৮৫৮ কোটি টাকা এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৩,৭৯৫কোটি টাকা দাবি জড়িত আছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'অর্থঋণ আদালতে বিপুল অঙ্কের টাকার মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে; কিন্তু আদায় হয়েছে খুবই কম। এটা আমাদের আর্থিক ব্যবস্থার দুর্বলতা ইঙ্গিত করে'।
তিনি আরো বলেন, 'ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ভালো গ্রাহককে ঋণ দেয় না। যার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুদিন পর খেলাপি গ্রাহক হয়ে যায়। এছাড়া গ্রাহককে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে যে জামানত (বন্ধকী) রাখা হয় প্রকৃত মূল্যের চেয়ে তার অতিরিক্ত মূল্য ধরা হয়। তাই কিছুদিন পর যখন কোনো ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়– তখন ঋণ আদায়ের সুযোগ আর থাকে না'।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০০৩ সালে অর্থঋণ আদালত গঠন হওয়ার পর ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ আদালতে মামলা হয়েছে ২,২২,৩৪৮টি। এসব মামলায় জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল ২,৪৯,১৮৪ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিংখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হলো ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের ৮.১৬ শতাংশ। অন্যদিকে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক বহির্ভুত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২৪.৬১ শতাংশ বা ১৭,৩২৭ কোটি টাকা।