এয়ারলাইনস তহবিলের ৯০ শতাংশই আটকে আছে বিদেশি ব্যাংকগুলোতে
বাংলাদেশে বিদেশি এয়ারলাইনসের যে পরিমাণ তহবিল আটকে আছে, তার ৯০ শতাংশই আটকে আছে দেশে কার্যরত বিদেশি ব্যাংকগুলোতে। ব্যাংকিং সূত্র অনুসারে, এরমধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের অধীনে আছে দেশের এয়ারলাইন ব্যবসার ৭০%।
এয়ারলাইনসের অর্থ পরিশোধ ত্বরান্বিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা সত্ত্বেও, বিদেশি ব্যাংকগুলো ডলার সংকটের কারণে যথাযথ সময়ে তা করতে পারছে না বলে রিপোর্ট করেছে এয়ারলাইনগুলো।
একটি সাম্প্রতিক প্রেস রিলিজে ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ) জানায়, বাংলাদেশে আটকে আছে ২১৪ মিলিয়ন ডলারের এয়ারলাইন তহবিল। সবচেয়ে বেশি তহবিল আটকে রাখা দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
এরপর গত ৬ জুন একটি সংবাদ সম্মেলনের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক এই পরিসংখ্যানটিকে বিতর্কিত দাবি করে জানায়, দেশে আটকে থাকা এয়ারলাইন তহবিলের পরিমাণ ১৭৭ মিলিয়ন ডলার। এয়ারলাইনসের পাওনা অর্থ দ্রুতসময়ে পরিশোধ করার আহ্বান জানায় তারা।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড প্রাপ্ত নথি থেকে দেখেছে, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড একাই এই আটকে রেখেছে তহবিলের ১৮২ মিলিয়ন ডলার।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের ক্লায়েন্ট কভারেজ, কর্পোরেট, কমার্সিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ব্যাংকিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান এনামুল হক বলেন, "এ বছর আমরা তহবিলের একটা বড় অংশ পরিশোধ করেছি।"
"এখন পর্যন্ত পরিশোধিত অর্থের পরিমাণ পরিমাণ বর্তমান বকেয়া থেকে বহুগুণ বেশি। বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া গেলেই আমরা বাফেদা'র নির্দেশিকা অনুসরণ করে আরও বেশি অর্থ পরিশোধের আশা করছি," বলেন তিনি।
ব্যাংকিং সূত্রে জানা গেছে, তুর্কিয়ে, কাতার এয়ার, সৌদি এবং মালয়েশিয়াসহ পাঁচটি এয়ারলাইন্সের ব্যবসা পরিচালনা করে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড। এমিরেটস, থাই এবং ইতিহাদের ব্যবসা পরিচালনা করে সিটিব্যাংক এন এ। ক্যাথে প্যাসিফিকের ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনা করে এইচএসবিসি।
স্থানীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে মালিন্দো, গাল্ফ এয়ার, এয়ার মারোক, ড্রুক এয়ার এবং এয়ার এরাবিয়ার কার্যক্রম পরিচালনা করে ব্র্যাক ব্যাংক এবং সালাম এয়ার পরিচালনা করে ইস্টার্ন ব্যাংক।
যোগাযোগ করা হলে মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা সত্ত্বেও তারা তাদের আটকে থাকা অর্থ উদ্ধার করতে পারেননি। তাদের ৪০০ কোটি টাকা আটকে আছে বলে জানিয়েছে এয়ারলাইনটি। শিগগিরই এর সাথে আরো ৭০ কোটি টাকা যোগ হবে।
তিনি আরো বলেন, নিজেদের তহবিলের অর্থ উদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশে ৯০% এয়ারলাইনস তাদের ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়েছে। ফ্লাইট কম থাকায় বেড়েছে টিকিটের দাম, যার ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন অভিবাসী শ্রমিকরা।
একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, লেবার রেমিট্যান্স না পাওয়ার কারণে বিদেশি ব্যাংকগুলো ডলার সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। তাই ডলারের উৎস হিসেবে এই ব্যাংকগুলো প্রাথমিকভাবে আন্তঃব্যাংক বাজার (ইন্টার-ব্যাংক মার্কেট) এবং রপ্তানি আয়ের ওপরেই নির্ভর করে।
তবে বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে আন্তঃব্যাংক বাজার অকার্যকর হয়ে পড়ায় বিদেশি ব্যাংকগুলো সংকটে রয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
বিদেশি ব্যাংকগুলো দ্বারা এয়ারলাইনসের তহবিল প্রেরণে বিলম্বের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি বা সময়সীমার বাধ্যবাধকতা না থাকার বিষয়টিকেই দায়ী করা হয়। অথচ এর বিপরীতে, ব্যাংকগুলোকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমদানির লেটার অফ ক্রেডিট (এলসি) পেমেন্ট নিষ্পত্তি করতে হয়।
যদিও বিদেশি ব্যাংকগুলোর এমন বিলম্বের কারণে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছে ও সবচেয়ে বেশি এয়ারলাইন তহবিল আটকে রাখা দেশের তালিকায় বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে আছে, তারপরেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কারণ রেমিট্যান্স সম্পর্কিত সমস্যাগুলো ব্যাংক-ক্লায়েন্ট সম্পর্কের আওতার মধ্যে পড়ে।
যেভাবে বাংলাদেশের কার্যক্রম থেকে মুনাফা দ্বিগুণ করে নিচ্ছে বিদেশি ব্যাংকগুলো
বাংলাদেশে কার্যরত তিনটি বিদেশি ব্যাংকই গত বছরে তাদের নিট মুনাফা দ্বিগুণ করতে সক্ষম হয়েছে। ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে ডলার বিক্রির মাধ্যমেই এই প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে।
যেমন- সিটিব্যাংক এনএ মার্কিন ডলার বিক্রি করে ৩৫০.৩৩ কোটি টাকার বিনিময় লাভ (এক্সচেঞ্জ গেইন) নথিভুক্ত করেছে, যা আগের বছরের ৬০.৭০ কোটি টাকার তুলনায় ৪৭৭ শতাংশ বেশি। ডলার বিক্রিতে এই উল্লেখযোগ্য আয় বৃদ্ধি সিটিব্যাংক এনএ-এর নিট মুনাফা ৭১৩ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। এর ফলে গত বছর সিটিব্যাংক এনএ-এর নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ২৪৯ কোটি টাকায়, যা আগের বছর ছিল ৩০.৬০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশের বৃহত্তম বিদেশি ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট অনুসারে, গত বছর ডলার লেনদেন থেকে ৫৫৪ কোটি টাকা লাভ করেছে তারা, যা আগের বছরের তুলনায় ৬৫.৬৫ শতাংশ বেশি।
ডলার বিক্রি থেকে বিপুল লাভের ফলে ২০২২ সালে ব্যাংকটির নিট মুনাফা দ্বিগুণ হয়ে ১,৬৫৫ কোটি টাকায় পৌঁছায়; এক বছর আগে মুনাফার পরিমাণ ছিল ৭৫৮ কোটি টাকা।
এদিকে, দ্য হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশন লিমিটেড, বাংলাদেশ (এইচএসবিসি বাংলাদেশ) দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনকারী বিদেশি ব্যাংক।
গত বছর এই ব্যাংকের নিট মুনাফা ৫৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৫৮৭.৯ কোটি টাকা এবং নিট সুদ আয় ১৩.৯ শতাংশ বেড়ে ৮৭৩ কোটি টাকা হয়েছে।
এছাড়া, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় থেকে ব্যাংকটির আয় হয়েছে ৪৪৯ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ২২৭ শতাংশ বেশি।