কেন অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি কমছে?
২০২১ সালে করোনা মহামারির প্রকোপের মধ্যে গবাদি পশু বেচাকেনার অনলাইন বাজার 'ডিজিটাল হাট'-এ প্রায় তিন লাখ ৮৭ হাজার কোরবানির পশু বিক্রি হয়েছিল। ২০২০ সালে প্রথমবারের ২৭ হাজারের তুলনায় যা ছিল অনেক বেশি।
তবে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্যমতে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রয়োজন না থাকায় ২০২২ সালে অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি কমে ৬৬ হাজারে নেমেছে। চলতি বছর যোগ হয়েছে মুদ্রাস্ফীতির চাপ। এতে বিক্রি আরও কমে ৫০ হাজারে নামতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
ই-ক্যাবের নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম শোভন মঙ্গলবার (২৭ জুন) দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এখন পর্যন্ত অনলাইনে বিক্রির হার আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে কম।' গত এক সপ্তাহে মৌসুমী পশুর হাটগুলো চালু হওয়ার পর অনলাইনে বিক্রির পোস্ট দুই-তৃতীয়াংশ কমে এসেছে বলে জানান তিনি।
সামাজিক দূরত্বের প্রয়োজনীয়তা না থাকা এবং মুদ্রাস্ফীতির পাশাপাশি জাহাঙ্গীর আলম বিক্রি কমার আরও কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন।
২০২১ সালে মহামারিকালীন ডিজিটাল হাট জেলা পর্যায় পর্যন্ত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত গবাদি পশু বিক্রেতাদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রিতে বড় অবদান রেখেছে। এই প্লাটফর্ম কোনো ধরনের ফি না নিয়েই অর্ডার নেওয়া থেকে শুরু করে বিক্রির অর্থ প্রক্রিয়াকরণ, পশু সরবরাহ এবং বিক্রেতার অর্থ পরিশোধ পর্যন্ত সবকিছু করেছে। জাহাঙ্গীর বলেন, শুধু অনলাইন পেমেন্ট প্রসেসিং ফি বাবদ ২ শতাংশের কম টাকা নেওয়া হয়েছে।
একটি বাণিজ্যিক অনলাইন প্লাটফর্ম না হয়েও ডিজিটাল হাট ২০২২ সালেও একই পদ্ধতিতে অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি করেছে।
ই-কমার্স উদ্যোক্তারা বলেন, ঈদুল আজহার মতো মৌসুমী ব্যবসায় অনলাইন প্লাটফর্মে মূল্য প্রতিযোগিতামূলক রেখে মানসম্পন্ন সেবা দেওয়া কষ্টকর। এছাড়াও, ঈদের আগে সড়কে চাঁদাবাজি এবং মহাসড়কে যানজট তাদের কাজকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
উদাহরণস্বরূপ, দেশের বৃহত্তম ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম দারাজ এই বছর কোরবানির পশু বিক্রি করছে না। তবে এটি ডিজিটাল হাটের পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে।
জাহাঙ্গীর বলেন, সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অনলাইনে গবাদি পশু বিক্রিতে গ্রাহকদের আস্থা ধরে রাখতে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে অনলাইন প্লাটফর্মগুলোকে।
উদাহরণস্বরূপ, তিন বছরে ১০ হাজারের বেশি খামারিকে যুক্ত করেও ডিজিটাল হাট সঠিকভাবে পশু ডেলিভারি করতে হিমশিম খাচ্ছে। পরিবহনের সময় অনেক ক্ষেত্রে পশুর ওজন ৫-৭ কেজি কমে যায়। কিছু সময় ছোট খামারিরা ভুল ওজন তুলে ধরেন। আবার অনেক সময় ডেলিভারির আগে পশু চুরি হয়ে গেছে।
কোনো বিক্রেতা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে সরকারি উদ্যোগ হিসেবে ডিজিটাল হাট মানুষের আস্থা ধরে রাখতে ভর্তুকিও দিয়েছে।
তবে ৩০০-৪০০ বিশেষায়িত খামার অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রিতে সাফল্য পাচ্ছে। তারা অনলাইনে নিজেদের খামারের প্রচার করছে। উপযুক্ত ক্রেতাদের খামারে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা ঈদের আগে আগে হোম ডেলিভারি পেতে তাদের কাছ থেকেই পশু কেনেন।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অনলাইনে কোরবানির গরু বিক্রিতে ৭০-৮০ শতাংশ অবদান ডিজিটাল হাটের। এদিকে মহামারির প্রকোপ কমার পর নিজস্ব সামাজিক মাধ্যমে পশু বিক্রি করা খামারির সংখ্যা বাড়ছে।
দুর্দান্ত অনলাইন ব্র্যান্ডিং করা সাদিক এগ্রো পশু বিক্রিতে সাফল্য পাচ্ছে। এ বছর তারা কোরবানিযোগ্য ১৯০০ গরু লালন-পালন করেছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত তারা ১৭০০ পশু বিক্রি করেছে।
সাদিক এগ্রোর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোহম্মদ ইমরান হোসেন টিবিএসকে জানান, এ বছর তাদের ই-কমার্স চ্যানেলে প্রায় ১৭৪টি পশু বিক্রি হয়েছে। গ্রাহকরা প্রথমবার ঘরে পশু দেখেছেন। বেশিরভাগ অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে অনলাইনে। ২০২২ সালে বিক্রি হয়েছিল ১৫০টি। তবে ২০২১ সালে প্রায় এক হাজারের কাছাকাছি পশু অনলাইনে বিক্রি হয়েছিল।
তিনি বলেন, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ এবং ধামাকার মতো প্লাটফর্মের প্রতারণার কারণে গ্রাহকের আস্থা কমেছে।
মাংস বিক্রিতে দেশের বৃহত্তম চেইনশপ বেঙ্গল মিট জানায়, তারা প্রতিদিন ৫০-৬০টি পশু জবাই করে। আর ঈদুল আজহার সময় এক থেকে দুই ডজন জ্যান্ত পশু সরবরাহ করে।
বেঙ্গল মিটের বিপণন প্রধান শেখ ইমরান আজিজ বলেন, 'আমরা জ্যান্ত গবাদি পশুর ডেলিভারি প্রচার করি না কারণ, ঝামেলামুক্ত থাকতে চান এমন গ্রাহকদের জন্য আমরা কোরবানির পশু জবাই করা, প্রক্রিয়াকরণ ও মাংস সরবরাহ করে থাকি।
২০২১ সালের ঈদুল আজহায় নিজেদের সর্বোচ্চ সক্ষমতায় এই ধরনের প্রায় ৫০০ গ্রাহককে পরিষেবা দেওয়া হয়। ২০২২ সালে তা কমে হয় ৩৫০ জন। এ বছরও প্রবণতা কমতির দিকে।
মাস্টারকার্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল টিবিএসকে বলেন, গবাদিপশু বিক্রির পেমেন্ট খুব কমই ডিজিটাল মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। কারণ মানুষজন এখনো নগদ বা ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করতে পছন্দ করেন।
২০২২ সাল থেকে পশু বিক্রেতাদের কাছে ডিজিটাল পেমেন্ট সেবা নিয়ে আসা স্মার্ট বাংলাদেশ, স্মার্ট হাট প্রকল্প গত বছর ঢাকার ছয়টি ঐতিহ্যবাহী হাটে ৩৩ কোটি টাকা লেনদেন করেছে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বছর ঢাকা ও চট্টগ্রামের ১০টি হাটে ১৫০ কোটি টাকা ডিজিটাল পেমেন্টের প্রত্যাশা করছে।
ডিজিটাল ভবিষ্যৎ
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও খামারি উভয়ের মতে দেশে অনলাইন বেচাকেনায় বিদ্যমান উত্থান-পতন স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না।
উদাহরণস্বরূপ, ময়মনসিংহের ত্রিশালে একটি সমন্বিত খামার করেছেন সফ্টওয়্যার উদ্যোক্তা মঞ্জুর। তিনি সেখানে গবাদি পশু লালন-পালন, মাছ, শাকসবজি ও ফল চাষ করেন। এ বছর মঞ্জুর তার ওয়েবসাইটে ১০টি গরু বিক্রি করেছেন। তার ওয়েবসাইট জাওয়াদ এগ্রো অনেকের কাছে পরিচিত পাওয়ায় আগামী বছরের জন্য ১০০টি গরু পালনের কথা ভাবছেন মঞ্জুর। প্রথম বছরে গ্রাহকদের সাড়া দেখে মঞ্জুর বলেন, গ্রাহকদের বিশ্বাসই আগামীতে বিক্রির মাত্রা বাড়াবে।
সাদিক এগ্রোর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিএফএ) সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, ঝামেলামুক্তভাবে ঈদুল আজহা কাটাতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাই যেসব খামারের মান, নিরাপত্তা ও মূল্য নিয়ে গ্রাহক সন্তুষ্ট হবে, আগামীতে তাদের অনলাইনে বিক্রির সংখ্যা বাড়তে থাকবে।
সাদিক এগ্রো এ বছর ৩৫০ জন গ্রাহককে কোরবানির পশু জবাই থেকে শুরু করে মাংস সরবরাহ পর্যন্ত সেবা দেবে।
ই-ক্যাবের নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর বলেন, ডিএফএ পশুর আকারের ওপর ভিত্তি করে একটি মূল্য নির্ধারণের মানদণ্ড দিয়েছে এবং অনলাইন ক্রেতা-বিক্রেতারা সে দামের আশেপাশে দর কষাকষি করে করছেন। অন্যদিকে ঈদুল আজহার সময় ঐতিহ্যবাহী হাটগুলোতে দাম অস্থিতিশীল দেখা যায় — হয় ক্রেতা না হয় বিক্রেতা, যে কোনো এক পক্ষ খুশি হন।
যেমন, ১০০ কেজির কম ওজনের ছোট গরুর দাম কেজিতে ৪৫০ টাকা এবং ৫০০ কেজির বেশি ওজনের গরুর দাম কেজিতে ৫৫০ টাকা নির্ধারণ করেছে ডিএফএ। ক্রেতা-বিক্রেতারা এ দামের কাছাকাছি দামে ক্রয় বিক্রয় করবেন।
জাহাঙ্গীর বলেন, অনেকেই ঐতিহ্যবাহী মৌসুমী গরুর হাটে দাম নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেতে এবং সুসংগঠিত অনলাইন বিক্রেতার কাছ থেকে অর্ডার করতে চান।
এই বছর অনেকেই তাদের বিশ্বস্ত খামারে কেনার জন্য পশু খুঁজেছেন এবং এ প্রবণতা আরও বাড়ছে। যা অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে পশু বিক্রি কমার একটি কারণ।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অনুমান, এই বছর দেশে ২১ লাখের বেশি কোরবানির পশু উদ্বৃত্ত থাকবে। কারণ এক কোটি ২৫ লাখ সম্ভাব্য সরবরাহের বিপরীতে আনুমানিক চাহিদা ছিল এক কোটি ৩ লাখ। সরবরাহের মধ্যে গরু ও মহিষ প্রায় ৪৮ লাখ, ছাগল ও ভেড়া ৬০ লাখ।
ই-ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রির প্রায় ৮০ শতাংশই হয় গরু বা ষাঁড়।