নিয়ম লঙ্ঘন করে ১১৫ টাকা রেটে ডলার লেনদেন করছে পাঁচ তারকা হোটেলগুলো
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া নিয়ম অমান্য করে বাংলাদেশের পাঁচ তারকা হোটেলগুলো ১১৫ টাকা রেটে ডলার লেনদেন করছে বলছে অভিযোগ করেছেন বিদেশি পর্যটকরা।
বাংলাদেশে বেড়াতে আসা বেশ কয়েকজন বিদেশি অভিযোগ করেন, এসব হোটেল ডলারে পেমেন্ট নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। এর পরিবর্তে টাকায় লেনদেন করতে চায় তারা।
এমনকি অনলাইনে রুম বুক করার ক্ষেত্রে ডলারে পেমেন্টের জন্য অনুরোধ করলে হোটেল কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি হয়নি বলে জানান তারা।
গত সপ্তাহে গুলশানের একটি পাঁচ তারকা হোটেলে একজন বিদেশি পর্যটক রুম বুক করেন। তিনি তার ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ডলারে পেমেন্ট করতে চাইলে হোটেল ডলারে পেমেন্ট নিতে রাজি হয়নি।
হোটেলটি প্রাথমিকভাবে রুম বুকিং এর খরচ ডলারেই উল্লেখ করলেও, পেমেন্টের সময় তারা টাকা ছাড়া লেনদেন করতে রাজি হয়নি। এক্ষেত্রে প্রতি ডলারে ১১৫ টাকা রেটে পেমেন্ট নিতে জোর দেন তারা।
ওই বিদেশি নাগরিক জানান, তিনি ব্যবসায়িক কাজে প্রায়ই ঢাকায় আসেন। গত কয়েক মাসের তুলনায় এবার একই রুমের জন্য তার ৭ হাজার টাকা বেশি পেমেন্ট করতে হয়েছে।
গ্রাহক হিসেবে ঢাকার গুলশানে অবস্থিত পাঁচতারকা হোটেল রেনেসাঁ-তে যোগাযোগ করা হলে সেখানকার বুকিং অপারেটর ডলারের জন্য অতিরিক্ত রেট নেওয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, হোটেল সাধারণত ডলারে পেমেন্ট গ্রহণ করে। কিন্তু কোনো গ্রাহক যদি টাকায় পেমেন্ট করতে চায় তাহলে ১১৫ টাকা রেটে ডলার হিসাব করা হয়।
হোটেলটির নিজস্ব ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে, '[হোটেলের] সব ধরনের পেমেন্ট স্থানীয় মুদ্রা টাকায় করতে হবে। এক্ষেত্রে হোটেলের মুদ্রা রূপান্তর হার অনুযায়ী পেমেন্ট হিসাব করা হবে।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ব্যাংকগুলো প্রতি ডলার সর্বোচ্চ ১০৯ টাকায় ডলার লেনদেন করছে। মানি-চেঞ্জাররা ব্যাংকের ডলারের রেটে ১ টাকা যোগ করে লেনদেন করতে পারেন।
তিনি বলেন, "হোটেলগুলো সীমিত আকারের মানি-চেঞ্জার। তারা শুধুমাত্র ডলার কেনার জন্য অনুমোদিত। অর্থাৎ তারা ডলার প্রতি সর্বোচ্চ ১১০ টাকা চার্জ করতে পারবে।"
"হোটেলগুলো যদি বেশি রেটে লেনদেন করে, তাহলে তা নিয়মের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন," বলেন তিনি।
দেশের আরেকটি পাঁচতারকা হোটেলের প্রধান ফিন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) টিবিএসকে বলেন, এ ধরনের রেট সারা বিশ্বে প্রচলিত। বর্তমানে বাংলাদেশের কার্ব মার্কেটে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১২ টাকা থেকে ১১৩ টাকায়। এ ছাড়া বাজারে ডলারের দর ওঠানামা করছে।
"অস্থিতিশীল ডলারের বাজার বিবেচনা করে আমরা এর রেট ১১৫ টাকা হিসাবে নিচ্ছি। শুধু আমরাই নই, বাংলাদেশের অন্যান্য পাঁচ তারকা হোটেলও একই হারে চার্জ নিচ্ছে," বলেন তিনি।
এই রূপান্তর রেট কীভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হোটেলগুলো নিজেরাই রূপান্তর রেট নির্ধারণ করে।
"বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যাসোসিয়েশন (বিহা) নির্ধারিত নয় এই রেট। কিন্তু, আমরা মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে রূপান্তর রেট নিয়ে আলোচনা করি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমাদের কোনো অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন নেই," যোগ করেন তিনি।
এ কর্মকর্তা আরো বলেন, হোটেলের আয়ের ৯৬ শতাংশ আসে রুম ভাড়া ও খাবারের বিল থেকে। তাই হোটেলগুলো ডলারের রেট বাড়িয়ে নিজেদের আয়ও ৪.৫% বাড়াতে পারে।
ওয়েস্টিন ঢাকা এবং শেরাটন ঢাকার প্যারেন্ট কোম্পানি ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট পিএলসি-র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাখাওয়াত হোসেনও ডলার প্রতি ১১৫ টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
তিনি বিহা'র পরিকল্পনা ও উন্নয়নের স্থায়ী কমিটিরও কো-চেয়ারম্যান। শাখাওয়াত টিবিএসকে বলেন, "আমরা গ্রাহকদের থেকে ডলারে পেমেন্ট নিচ্ছি। তবে যেকেউ চাইলে টাকায় পেমেন্ট করতে পারবেন। সাধারণত, একটি আন্তর্জাতিক হোটেল হিসেবে আমরা আমাদের ভাড়া ও খাবারের দাম ডলারে উল্লেখ করি।"
এছাড়া আরো কিছু হোটেল আছে যারা টাকা ও ডলার দুই মুদ্রাতেই পেমেন্ট নেয়, এবং নিয়মও মেনে চলছে। যেমন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাঁচ তারকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা দুই মুদ্রাতেই পেমেন্ট গ্রহণ করে। হোটেলের বুকিং হটলাইন অনুযায়ী, ডলারের রেট ১১০ টাকা।
তবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ডলারের রেট বিষয়ক নিয়ম লঙ্ঘনকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিত ব্যবস্থা নেয়। বিগত বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কয়েকটি ব্যাংককে এ নিয়ে সতর্ক করেছে এবং নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি হারে ডলার লেনদেনের জন্য জন্য সংশ্লিষ্টদের শাস্তিও দিয়েছে।
২০২২ সালের এপ্রিলে ডলারের সংকট শুরু হওয়ার পরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আইন প্রয়োগকারী সংশ্লিষ্টরা, অতিরিক্ত চার্জ করা মানি চেঞ্জারগুলোতে বেশ কয়েকটি অভিযান চালায়।
এসব অভিযানে ডলার রেট বিষয়ন নানা অনিয়মের অভিযোগে ৪২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় এবং পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়।